মুক্তিযুদ্ধে স্বামী হারালেও জীবনযুদ্ধে হার মানেননি খুলনার আবেদা খানম

খুলনা প্রতিনিধি: জীবনের বাস্তবতাকে অনেক কাছ থেকে দেখা নারীদের মধ্যে একজন আবেদা খানম। মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছেন তার স্বামীকে। তখন থেকেই দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় তার জীবনের নতুন অধ্যায়। সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে সংসারের হাল তুলে নেন নিজের কাঁধে। নকশী কাঁথা সেলাই, মাদুর বুনন ও পাখা তৈরি দিয়েই তার সংগ্রামী জীবনের যাত্রা শুরু। সেই থেকে এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন এ হস্তশিল্পের ব্যবসা। পাশাপাশি এলাকার নারীদের উন্নয়নেও কাজ করে চলেছেন। অবদান রেখেছেন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও। এসব দক্ষতা দিয়েই জয় করে নিয়েছেন সোনার মেডেলসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা। আর এভাবেই কাটিয়ে দিতে চান জীবনের বাকিটা সময়।
ষাটোর্ধ্ব আবেদা খানম খুলনা মহানগরীর রায়ের মহল এলাকার মেয়ে। রূপসা উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়নের খান মোহাম্মদপুর গ্রামে বসবাস তার। মাত্র ১২ বছর বয়সে এই গ্রামের প্রয়াত শেখ মমিন উদ্দিনের সাথে বিয়ে হয় তার। লেখাপড়া জানা সত্ত্বেও রক্ষণশীল পরিবারে থাকার কারণে বাইরের জগতের সাথে তেমন পরিচয় ছিল না। তার স্বামী ছিলেন একজন মিল শ্রমিক।
বিয়ের সাড়ে সাত বছরের মাথায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কর্মস্থল থেকে নিখোঁজ হন তিনি। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন আবেদা। বেঁচে থাকার তাগিদে সংসারের হাল ধরেন তিনি। বাইরের জগত তখনও তার কাছে অচেনা অজানা। তাই ঘরে বসেই শুরু করেন নকশী কাঁথা সেলাই, মাদুর বুনন ও হাতপাখা তৈরির কাজ। স্থানীয় এক পরিচিতা’র সাহায্যে চিনতে শুরু করেন রাস্তাঘাট। আর তৈরিকৃত পণ্যগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে থাকেন। এভাবেই ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকে তার ব্যবসার পরিধি।
পরবর্তীতে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে মাদুর বুনন, পাট দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি, কারচুপি ও কাগজের ঠোঙা তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। এরপর গ্রামে সদ্য গড়ে ওঠা পরিবার পরিকল্পনা কল্যাণ কেন্দ্রের সম্পাদিকার দায়িত্ব পেয়ে যান তিনি। সেই থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আবেদা খানম পরিবার পরিকল্পনা সমিতির সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। এর সহযোগিতায় নিজ বাড়িতে স্যাটেলাইট ক্লিনিকের মাধ্যমে মা ও শিশুর চিকিৎসা সেবাও প্রদান করছেন তিনি। নিজ উদ্যোগে বাড়িতে সার ডিলারশিপ নিয়েও এর ব্যবসা করেছেন। তার কর্মদক্ষতার জন্যে আনসার-ভিডিপি’র প্রশিক্ষণ গ্রহণেরও সুযোগ পান। পাশাপাশি এর সদস্যপদও লাভ করেন। বর্তমানে তার ইউনিয়নে আনসার-ভিডিপি’র দলনেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া কুটির শিল্প ও সমবায় সমিতির উপরও বেশ কিছু প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বর্তমানে তার এখানে স্থায়ীভাবে প্রায় ৪৫ জন কর্মী কাজ করছে।
নিজ উদ্যোগে ১৯৮৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত নারীদের উন্নয়নে তিনটি সমিতি গড়ে তুলেছেন। খান মোহাম্মদপুর নারী সমাজকল্যাণ সমিতি তার গঠিত প্রথম সমিতি। মাত্র ৫ জন সদস্য নিয়ে শুরু হয় এ সমিতির অগ্রযাত্রা। এছাড়া আরও দু’টি সমিতি রয়েছে তার। এসব সমিতিতে বর্তমানে মোট ৩শ’ সদস্য রয়েছে। এরা সকলেই এখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। সমিতির মাধ্যমে এসব সদস্যদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকেন। এর মধ্যে মশারি তৈরি, নেটের ব্যাগ, কাগজের ঠোঙা, কারচুপি, বাটিক, এ্যাপ্লিক, দর্জি কাজ প্রভৃতি প্রশিক্ষণ দেন। এছাড়া সুদমুক্ত ঋণ গ্রহণ, জমি ক্রয়, গবাদি পশু ক্রয়সহ সদস্যদের স্বাবলম্বী করার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে। এর মধ্যে বয়স্ক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা, শিশু শিক্ষা, দর্জি বিজ্ঞান, ক্রসের কাজ, উলের কাজ, নকশী কাঁথা, তোয়ালের উপর নকশি, চটের উপর নকশি, এমব্রয়ডারী, পাটি বুনন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
স্থানীয় বাজার চাহিদা অনুযায়ী সদস্যদের তৈরিকৃত পণ্য খুলনাসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আবেদা খানম নিজেই সরবরাহ করে থাকেন। তার এসব অসামান্য কাজের জন্য সোনার ও রূপার মেডেলসহ অসংখ্য পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে শ্রেষ্ঠ সংগঠিকা এবং আনসার ভিডিপি বাহিনীতে ভালো কাজের জন্য জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন। ১৯৯৭ সালে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইন এর একটি পরিদর্শন টিম তার সমিতির কুটিরশিল্পের কাজ পরিদর্শন করেন। সে বছরই ভারত ও শ্রীলঙ্কা সরকারের আমন্ত্রণে শ্রেষ্ঠ সংগঠিকা হিসেবে ভারত ও শ্রীলঙ্কা সফর করেন। ২০০৩ সালে তিনি ইউপি নির্বাচনে মহিলা মেম্বর পদে নির্বাচিতও হন। ২০০৫ সালে এনজিও কর্মী হিসেবে এবং শ্রেষ্ঠ ইউপি সদস্য হিসেবে ব্র্যাক ও সুশীলন এনজিও এর মাধ্যমে ফিলিপাইন ভ্রমণের সুযোগ পান। ২০১৩ সালে তিনি জয়িতা পুরস্কারও পান।
এই উদ্যোমী নারী বলেন, ‘একাত্তরে স্বামীকে হারানোর পর দুই ছেলেকে নিয়ে খুবই একা হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের দায়িত্ব নেওয়ার মতো শ্বশুরবাড়ির তেমন কেউ বেঁচে ছিল না। রক্ষণশীল পরিবার হওয়ায় এলাকার রাস্তাঘাটও তেমন চিনতাম না। কিভাবে কি করব বুঝতে না পেরে প্রথমে এক মহিলাকে সাথে নিয়ে এলাকার রাস্তাগুলো চিনেছিলাম। বাড়িতে বসে তৈরি করতে থাকি নকশী কাঁথা, মাদুর বুনন ও হাতপাখা। ছোটবেলায় মা এবং ভাবীদের কাছ থেকে সেলাইয়ের কাজ শিখেছিলাম। তখন মূলত বেঁচে থাকার জন্যই এ কাজগুলো বেছে নিয়েছিলাম। আর সেই থেকে কাজ করতে করতে বর্তমানে এ পর্যায়ে এসেছি। নিজে বাঁচার পাশাপাশি এখন অন্যদের বাঁচানোর লক্ষ্যে এসব সমিতিগুলো গড়ে তুলেছি। প্রশিক্ষণ দিচ্ছি হস্তশিল্পের এসব কাজের। এর মাধ্যমে এ এলাকার অনেকেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে।’
এতকিছুর পাশাপাশি তিনি একজন সফল মা-ও। দুই ছেলেকেই গড়ে তুলেছেন নিজের মত করে। বড় ছেলে একজন ব্যাংকার এবং ছোট ছেলেও গ্রামীণ ডাক্তার হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি আরও বলেন, ‘বাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগে না। তাই জীবনের বাকিটা সময়ও এভাবে কাজ করে যেতে চাই।’