সবুজ বাংলা অনলাইন ডেস্ক//একাদশ সংসদ নির্বাচন কাল। নীরব ভোট বিপ্লবে জয়ের আশায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচনে জয়লাভ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে ক্ষমতায় যেতে আশাবাদী বিএনপি নেতৃত্বাধীন এ নির্বাচনী জোট। ভোটের দিন ক্ষমতাসীন দলের একতরফা মাঠ দখলে নেয়ার প্রচেষ্টা রুখে দিতে নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশ দিয়েছে দলটির নেতারা। তারা মানবকণ্ঠকে বলেন, রুখে দিতে পারলে বিফল হতে হবে না। এ কারণে গ্রেফতার এড়িয়ে কাল ভোটের দিন কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সংখ্যক নেতাকর্মী রাখার কৌশল নিয়েছেন তারা। তবে হামলা-মামলা-গ্রেফতারের কারণে বর্তমান আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে প্রতিটি কেন্দ্রে ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট দেয়াকে যথেষ্ঠ চ্যালেঞ্জিং মনে করছে বিএনপি। আর নির্বাচনী মাঠে সেনাবাহিনীর তৎপরতাকে কাজে লাগাতে বলা হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী মনিটরিং সেল থেকে। তারা জানান, নির্বাচনের দিন যেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ভোটারদের ভোট কেন্দ্র আসতে বাধা বা ভয়ভীতি প্রদর্শন করবে, সেখানে সেনাবাহিনীকে অবগত করলে তাৎক্ষণিক ভালো ফল পাবে বলে আশা বিএনপির নেতাদের।
আর বিগত স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতাকে এক্ষেত্রে কাজে লাগিয়ে প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য একাধিক পোলিং এজেন্ট প্রস্তুত ও গ্রেফতার এড়াতে তাদের নিরাপদে রাখার চেষ্টাও রয়েছে বিএনপির। ভোট রক্ষায় কেন্দ্র পাহারায় কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, ভোটের ফলাফল গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত যে কোনো মূল্যে কেন্দ্রে অবস্থান করতে হবে এবং কোনো কেন্দ্র এজেন্ট শূন্য রাখা যাবে না। নির্বাচনের দিন ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে ধানের শীষের প্রার্থীদের বিজয়ী করার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মৃতপ্রায় গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে ধানের শীষে ভোট দিন। ভুয়া সরকার ও নির্বাচন কমিশন মিলে গণতন্ত্রকে জবাই করে হত্যা করেছে। তাদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। তিনি জানান, এ সরকার মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। জনগণের সংগঠন করার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আমি বলব, গণতন্ত্রের স্বার্থে সবাই ৩০ ডিসেম্বর ভোট দিন, কেন্দ্র পাহারা দিন। গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করুন।
এদিকে নির্বাচন কমিশনের তফসিল মোতাবেক গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টায় শেষ হয়েছে প্রচারণা কার্যক্রম। কিন্তু নির্বাচনের প্রচারণায় হামলা, মামলা, গ্রেফতারসহ চরম বৈরি পরিবেশ মোকাবিলা করতে হয়েছে বিএনপিকে। এক ভীতি ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই প্রচারণা শেষ করছে বিএনপি-জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। গণসংযোগকালে ধানের শীষের অন্তত ৩০ জন প্রার্থী ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও পুলিশের হামলার শিকার হয়েছেন। এখনো অন্তত ১০ জন প্রার্থী অবরুদ্ধ। একাধিক প্রার্থী পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন। সারা দেশেই বেশির ভাগ আসনে ধানের শীষের প্রার্থীর প্রচারণায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলা থেকে রেহাই পাননি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মতো হেভিওয়েট প্রার্থীরাও। তবে এমন চরম ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যেও নির্বাচনের মাঠে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে চাইছে বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন না তারা। এই রাজনৈতিক জোটের বিশ্বাস, মানুষ অবাধে ভোট প্রয়োগের সুযোগ পেলে ধানের শীষের বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। কাল ৩০ ডিসেম্বর নীরব ভোট বিপ্লব হবে। প্রচারণার শেষ দিনের আগের দিন বৃহস্পতিবার রাজধানীতে সমাবেশের কর্মসূচি ছিল ঐক্যফ্রন্টের। প্রতিকূল পরিবেশেও শেষ মুহূর্তে এ সমাবেশে ব্যাপক জনসমাগম ঘটিয়ে দেশবাসীর কাছে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি ও জনপ্রিয়তার বার্তা দেয়ার পরিকল্পনা ছিল ফ্রন্টের। কিন্তু অনুমতি না পাওয়ায় সে সমাবেশ করতে পারেনি।
বিএনপির নির্বাচনী মনিটরিং সেল ও কেন্দ্রীয় দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত সারা দেশে মোট ৯ হাজার ৩০২ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময়ে মোট ৮০৬টি গায়েবি ও মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। সারা দেশের ৩০০ আসনে মোট দুই হাজার ৭১৬টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে মোট ১২ হাজার ৫৮৮ জন নেতাকর্মী ও সমর্থক আহত হন। এসব ঘটনায় কমপক্ষে আটজন মারা গেছেন।
অপরদিকে নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিনের মিছিল ও গণসংযোগ সবসময়ই বিশেষ গুরুত্ব পায় ভোটারের কাছে। এ দিন প্রার্থীরা চেষ্টা করেন, তার মিছিলটিই যেন সবচেয়ে বড় হয়, তার প্রচারই যেন সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়, আর ভোটাররা আগ্রহী হন তার প্রতি। মিছিলের আকার দোদুল্যমান ভোটারের মন ঠিক করে- এমন কথাও প্রচলিত ছিল একসময়। তবে শুক্রবার সকাল ৮টা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারের শেষ দিনে বিএনপির প্রার্থীদের প্রচারে এমন দৃশ্যের দেখা মেলেনি। সারাদেশে ক্ষমতাসীন মহাজোটের প্রার্থীদের ব্যাপক প্রচারের বিপরীতে ভোটের মাঠে ধানের শীষ কোথাও সরব ছিল, কোথাও ছিল নীরব। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ভয়ভীতি দেখিয়ে জনসাধারণের ভোটকেন্দ্রে যাওয়া সরকার রুখতে পারবে না। আপনারা সকাল সকাল ভোট দিয়ে ভোট গণনা শেষ করে বাড়ি ফিরবেন। এ সময় তিনি ৩০ ডিসেম্বর ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার আহ্বান জানান।
অন্যদিকে সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ইসিতে যান ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। কিন্তু নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ শুনতে অনীহার কারণে সিইসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে বৈঠক বর্জন করেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ওইদিন রাতেই বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে ফ্রন্টের নেতারা জরুরি বৈঠক করে অবিলম্বে সিইসির পদত্যাগ দাবি করেন। এরপর গত বুধবার একইস্থানে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক হয়। উভয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়- সরকারি দল, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে যতই বৈরি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হোক, কোনোভাবেই মাঠ ছাড়া যাবে না। সরকার একতরফা নির্বাচনে আর কী কী করতে পারে, তা চূড়ান্তভাবে দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক মহলের সামনে উন্মোচন করার জন্য শেষ পর্যন্ত মাটি কামড়ে মাঠে থাকতে হবে। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলছেন, কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি যাতে বাড়ে, সে লক্ষ্যে চেষ্টা চালানোই এখন তাদের মূল কাজ। কারণ, ভোটাররা ব্যাপকভাবে ভোটকেন্দ্রে গেলে সরকারি দলের ভোট কারচুপির নির্বাচনী ছক কাজ করবে না।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে তরুণ ভোটারের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি ৪০ লাখ হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, তারাই ভোটের ফলাফলে বড় ভূমিকা রাখবেন। ইতিমধ্যে তরুণ ভোটারদের উদ্দেশে ড. কামাল হোসেন ও মির্জা ফখরুল ইসলামসহ সিনিয়র নেতারা পৃথক ভিডিওবার্তা দিয়েছেন। সেখানে তরুণদের জেগে উঠতে এবং পছন্দের প্রার্থীকে সকাল সকাল ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে কোনো দল বা প্রার্থীকে ভোট দেয়ার কথা বলা হয়নি ভিডিওবার্তায়। সূত্র জানায়, নির্বাচনের শেষ দুই দিনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
ঢাকা-৪ আসনের প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদ অভিযোগ করে বলেন, তিনি তিন দিন ধরে বাড়িতে অবরুদ্ধ। শ্যামপুরের নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে জানতে চাই, মাঠ কীভাবে সমতল। নেতাকর্মীদের বাড়িতে আসতে দিচ্ছে না, মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার-হামলা সবই হচ্ছে। তার বাড়ির সামনে পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা পাহারা দিচ্ছে। ভোটের দিন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ঢাকা-৫ আসনের প্রার্থী নবীউল্লাহ নবী গতকাল ভোটের প্রচারে বলেছেন. জীবনের শেষ বিন্দু রক্ত দিয়ে হলেও মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনবেন। কোনো অপশক্তিই নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারবে না। ভোটের প্রচারে নামতে না পেরে ঢাকা-৮ আসনের প্রার্থী মির্জা আব্বাস সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ভোটার সিøপ ও পোলিং এজেন্টদের সরবরাহ করা নির্বাচনসামগ্রী নিয়ে যাওয়ার সময় দলীয় নেতাকর্মীদের আটক করা হচ্ছে। ভয়ভীতি ও বাধা উপেক্ষা করে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
ঢাকা-১২ আসনের প্রার্থী সাইফুল আলম নিরবের পক্ষে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় নির্বাচনী মিছিল করেছেন তার নেতাকর্মীরা। ঢাকা-১৩ আসনের প্রার্থী আবদুস সালামের পক্ষে তার স্ত্রী প্রচারে অংশ নেন। ঢাকা-১৪ আসনের প্রার্থী সৈয়দ আবুবকর সিদ্দিক সাজু ভোটের প্রচারে নেমে বলেন, ধানের শীষের পক্ষে যে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে, তা ঠেকানোর ক্ষমতা সরকারের নেই। তিনি দারুসসালাম এলাকায় দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে গণসংযোগ করেন। গত ১০ ডিসেম্বর ভোটের প্রচার শুরুর পর নামতে না পারলেও গত বুধবার থেকে ঢাকা-১৫ আসনে গণসংযোগে নামেন ধানের শীষের প্রার্থী জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের কর্মী-সমর্থকরা। গতকাল শুক্রবার সকারেল মিরপুর-কাফরুলের বিভিন্ন এলাকায় ধানের শীষের পক্ষে ভোট চেয়ে মিছিল করেন তারা।
নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারের শেষ দিনে গতকাল ঢাকার বাইরের বিভাগীয় শহরগুলোতেও প্রচার ও গণসংযোগে নামেন বিএনপির প্রার্থীরা। তবে বেশ কিছু স্থানে তারা বাধার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট ও রংপুরে বিএনপি প্রার্থীদের অনেকেই কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে প্রচার চালান। অনেকে প্রচারে না নেমে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।