ভাষা সংগ্রামী সাংবাদিক মফিজ আলী ১০তম মৃত্যু বার্ষিকী ১০ অক্টোবর

জয়নাল আবেদীন,কমলগঞ্জ(মৌলভীবাজার)প্রতিনিধি//
আদর্শের কাছে নিজের জীবনকে জলাঞ্জলি দিয়েও কোন ধরনের সুযোগ-সুবিধার কাছে হার না মানা একটি আদর্শের নাম মফিজ আলী। ছাত্র জীবনেই রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি তুখোড় সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা, ক্ষুরধার লেখনি, প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, ভাষা সংগ্রামী, চা শ্রমিক নেতা, বালিশিরা ও হাওর করাইয়া কৃষক আন্দোলনসহ বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনেরও একজন বলিষ্ট নেতা হিসাবে সমধিক পরিচিত মুখ। বৃহত্তর সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনের এমন একটি নাম কমরেড মফিজ আলী আজ ১০ অক্টোবর প্রয়াত এই নেতার দশম মৃত্যু বার্ষিকী।
এসব কারনেই তিনি অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাখান করে ভাঙ্গা কুড়েঘরে দু:খ-কষ্টের সাথেই জীবন কাটিয়েছেন। এ ধরনের একজন নির্মোহ, নির্লোভ ব্যক্তি তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি বছর কারাগারে রাজবন্দীর জীবন যাপন করেন। প্রচলিত সমাজে অবহেলিত, শোষিত, নিষ্পেষিত শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া আদর্শিক একটি নাম মফিজ আলী। জীবনের শেষ সময়েও লেখালেখির পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণির অধিকার আদায়ে ছিলেন সোচ্চার।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনকালীন ২০০৮ সনের ৩০ আগষ্ট দুর্ঘটনা কবলিত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ অক্টোবর ভোর রাতে সিলেট ওসমানী হাসপাতালেই মৃত্যুবরন করেন।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রীসূর্য্য ধূপাটিলা গ্রামের একটি স¤্রান্ত পরিবারে ১৯২৭ সালের ১০ ডিসেম্বর মহান এই ব্যক্তির জন্ম। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে ছাত্রজীবনে বি.এ. ৪র্থ বর্ষ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। মৌলভীবাজার সরকারী হাইস্কুল থেকে ১৯৪৯ সালে তিনি মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৫০ এর দশকে শুরু হয় তাঁর কলেজ জীবন। মদন মোহন কলেজ থেকে আই.এ. পাশ করার পর এম.সি. কলেজে ভর্তি হন। ছাত্র ইউনিয়নের কার্যকলাপের জন্য এম.সি. কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ সুলেমান চৌধুরী মফিজ আলীকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করায় তাঁর পক্ষে ডিগ্রি পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি।
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি পাকিস্তান আমলে ডন, ইত্তেফাক, সংবাদ, জনতা, আজাদ, গণশক্তিসহ বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত সংবাদ ও কলাম লিখেছেন। ষাটের দশকে তিনি দৈনিক সংবাদ এর নিজস্ব প্রতিবেদক ছিলেন। ছাত্রজীবনে তার প্রকাশিত পুস্তিকার নাম “পাকিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের নমুনা।” পঞ্চাশের দশকে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে লেখা প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে “রাষ্ট্রভাষা ও আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন”, “মে দিবসের ইতিহাস” এবং ঈদ সংখ্যায় ছোট গল্প “একটি গামছা।” মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সেবা পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। তবে তিনি সব সময় ছিলেন প্রচার বিমুখ। নিজেকে সবসময় প্রচার প্রচারনার উর্দ্ধে রেখেছেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সেই সংগ্রামী দিনগুলোতে মফিজ আলী সিলেট এমসি কলেজের ছাত্র অবস্থায় কলেজে আন্দোলনের ফাঁকে এলাকায় ছুটে আসেন। তিনি ক্ষমতাসীন সরকারের রক্তচক্ষুতে আঙ্গুল দিয়ে কমলগঞ্জে তখনকার সময়ে ভাষা আন্দোলনের জন্য সাহসী নেতৃত্ব প্রদান করেন। অত:পর সিলেটে ছাত্র ইউনিয়নের জেলা কমিটিতে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। মৌলানা ভাসানীর গঠিত কৃষক সমিতির বৃহত্তর সিলেট জেলা কমিটির প্রথমে সহ সম্পাদক এবং পরে সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।
১৯৬০ সালে তিনি কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। রাজনৈতিক কারনে ১৯৬০ সালে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করার ২ বছর পর মুক্তি পান। ১৯৬৩ সালে তিনি শ্রীমঙ্গলে বালিশিরা কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ছালিক ও গনু মিয়া নামের দুই কৃষক মারা যান। ১৯৫৪, ১৯৬০, ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৭, ১৯৬৯ ও ১৯৭২ সালে বিভিন্ন মামলায় তিনি দীর্ঘ ৬ বছর রাজবন্দী হিসাবে কারাবরন করেন।
চা শ্রমিকদের দুঃখ দুর্দশা দেখে তিনি ১৯৬৪ সালে চা শ্রমিক নেতা কর্মীদের নিয়ে “পূর্ব পাকিস্তান চা শ্রমিক সংঘ” নামে একটি শ্রমিক ইউনিয়ন দাঁড় করান। এই ইউনিয়নের খবর পেয়ে চা বাগান মালিক ইউনিয়নের নেতারা মফিজ আলীকে গ্রেফতার করাতে মরিয়া হয়ে উঠে। নিজের লোভ লালসার উর্ধ্বে থেকে দেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তিনি আপোষহীন রাজনীতি করেন। এ ধরনের সম্পূর্ন নির্মোহ, নিঃস্বার্থবান একজন মানুষ জীবনে কখনও নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ অর্থবিত্তের দিকে ফিরেও তাকাননি। তিনি নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য, তা ধ্রুব নক্ষত্রের মতো পথ দেখাবে পথের মানুষদের এবং তাঁর এই ত্যাগী জীবন দর্শন অনন্তকাল সকলকে প্রেরণা যোগাক, তাঁর এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হোক এ মহান এই ব্যক্তির দশম মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।