এস এম মেহেদী হাসান,স্টাফ রিপোর্টার//
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় সাত দফা ও ১২ দফা লক্ষ্য ঘোষণা করেছে বিএনপি। সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি, প্রকৃত পক্ষে জনগণেরই দাবি। বিএনপি কিংবা তার নেতৃত্বাধীন জোট দেশের জনগণের সমর্থন নিয়ে রাজনীতি করছে এবং এই রাজনীতির সঙ্গে রয়েছে ব্যাপক জনসম্পৃক্তি। দেশে নির্বাচনের পরিবেশ-পরিস্থিতি কতটা বিদ্যমান- এ প্রশ্নের উত্তর জটিল কিছু নয়। যেখানে অধিকারের ভূমি সমতল নয়, গণতান্ত্রিক রাজনীতির অধিকারের শর্তগুলো অনুমতিনির্ভর, সেখানে এমন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা করা দুরূহ। বিএনপির সাত দফা আওয়ামী লীগ প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রত্যাখ্যান কতটা যুক্তিযুক্ত। সবকিছুই যদি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা থাকে, তাহলে তা গণতন্ত্র বিকাশের জন্য মোটেও সহায়ক নয়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে নির্বাচনের নামে যা হয়েছিল এমনটি আবার হওয়ার অবকাশ থাকুক, তা মোটেও কাম্য নয়। এর ছায়া যেন এ দেশের কোনো নির্বাচনে আর না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে এবং করতে হবে দেশের রাজনীতিকদেরই। নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হলে রাজনীতিকরাই প্রশংসিত হবেন। শুধু দেশের ভেতরে নয়, বিশ্বের সর্বত্রই। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ এ মুহূর্তে রয়েছে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে। ছোট্ট ভালো কাজটি তাদের চোখে দেখা দেবে অনন্য কর্মরূপে, একটি অনুকরণীয় উদ্যোগরূপে। আমাদের সৌভাগ্য, বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণতন্ত্রের আবেদন অত্যন্ত আকর্ষণীয়। গণতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা তারা বরাবরই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সৈনিকরূপে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ত্যাগ স্বীকারও করেছেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশীদার হয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশ
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তাদের হতাশার মূল কারণ এই যে, তখনকার ৯ কোটি ১৯ লাখ ভোটারের মধ্যে চার কোটি ৮৩ লাখ ভোটার ভোটদানে বঞ্চিত হন। পাশ্চাত্যের উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে গণতন্ত্র সফল হয়েছে প্রধানত দুটি কারণে- এক. যে সামাজিক উপত্যকায় গণতন্ত্রের সুর ঝঙ্কৃত, তা মোটামুটিভাবে মসৃণ ও সমতল। বৈষম্য, তা সম্পদ সৃষ্ট হোক আর জাতিগত বা ধর্মের ভিন্নতাহেতু হোক, ওইসব সমাজে অনতিক্রম্য নয়। নয় অজেয়। আজ যিনি নির্ধন, আগামীকাল সমাজ প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধার ফলে তিনিও শীর্ষ অবস্থানে যেতে সক্ষম। জাতি-ধর্ম বা নৃতাত্ত্বিক ভিন্নতা তার অগ্রগতির অভিযাত্রা রুদ্ধ করতে পারে না। তাই সমতল সমাজ ভূমিতে নাগরিকদের জীবন হয়ে উঠেছে শ্যামল, সমৃদ্ধ, সুষমামণ্ডিত; দুই. ওইসব সমাজে অর্থনৈতিক সুখ-সুবিধাও এমনভাবে বিন্যস্ত যে, প্রত্যেকেই জীবনের সর্বনিম্ন চাহিদা মিটিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন। দেশের আইন এমনভাবে কার্যকর যে, আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে সবাই জীবনযাপন করতে পারবেন। এসব সমাজে কাউকে মানবেতন জীবনযাপনে বাধ্য হতে হয় না। সুতরাং উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজগুলোর চুলচেরা বিশ্নেষণে প্রবৃত্ত হোন, দেখবেন গণতন্ত্রকে সফলভাবে বাস্তবায়নের সব শর্তই প্রায় সামাজিক, রাজনৈতিক নয়। কার্যত পাশ্চাত্যে গণতন্ত্রের জন্ম হয়েছিল সামাজিক এক ব্যবস্থা হিসেবে। সমাজেই তার দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। পরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার সার্থক প্রয়োগ ঘটে। আগে সমাজ গণতান্ত্রিক হয়েছে, পরে রাষ্ট্র হয়েছে গণতান্ত্রিক। বাংলাদেশে বিশেষ করে বিশ্বের এই অংশে, রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বৈষম্যক্লিষ্ট, হাজারো প্রকরণে বিভক্ত, জাতি-ধর্মের ভিন্নতাপীড়িত সমাজে। এসব সমাজে সামাজিক মূল্যবোধ এখনও গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠেনি। হয়ে ওঠেনি পারস্পরিক সমঝোতা ও সহিষুষ্ণতার অমৃত রসে সিক্ত।
সহনশীলতার পাঠ সমাজ জীবনে এখনও শুরু হয়নি। তাই এসব গণতান্ত্রিক-সামাজিক মূল্যবোধহীন জনপদে রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রতি পদে হোঁচট খাচ্ছে। টিকে রয়েছে টলটলায়মান অবস্থায়। হাজারো অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। তাই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার নির্দেশনা হলো- সৃজনশীল রাজনৈতিক নেতাদের গতিশীল নেতৃত্বের আলোকে গণতন্ত্র বিকাশের জন্য সমাজে গণতন্ত্রের উর্বর ক্ষেত্র রচনা করা। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, রাজনৈতিক নেতারা এখনও তেমন সৃষ্টিশীল উদ্যোগ নেননি। গণতন্ত্রের এমন মহামূল্যবান মণিমুক্তা তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে তারা শুধু দেখেছেন ব্যক্তিগত এবং দলীয় পর্যায়ে প্রভাব-বৈভব অর্জনের মাধ্যম হিসেবে। কখনও গভীরভাবে ভেবে দেখেননি যে, রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে পুরো সমাজকে নতুনভাবে গড়ে তোলা সম্ভব। যারা ক্ষমতাসীন তারাও এ ভুল করেছেন। যারা ক্ষমতা দখলে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তারাও এ বিষয়ে সজ্ঞাত নন। পাশ্চাত্যে গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য জনগণের সচেতনতা যতটুকু দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাজনৈতিক নেতাদের দৃঢ়সংকল্প এবং সৃজনশীল মনমানসিকতা। বাংলাদেশে প্রথমটি বিদ্যমান থাকলেও দ্বিতীয়টির আকাল চোখে পড়ার মতো।
গণতন্ত্রে নির্বাচনের মাধ্যমেই কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণই ক্ষমতার মূল উৎস। জনগণই রাজনৈতিক ক্ষমতার মালিক-মোক্তার। যারা ক্ষমতাসীন হলেন জনগণের সম্মতি নিয়েই, ক্ষমতাসীন হলেন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। ওই সময় অতিক্রান্ত হলে জনগণের কাছেই ফেরত যেতে হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণই নির্ধারণ করেন কারা ক্ষমতাসীন হবেন সেই সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য। তাই বলা হয়, সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য করা। যে কোনো রাষ্ট্রে জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা বা জাতীয় সংসদ (আমাদের ক্ষেত্রে) সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। এ কথা সবসময় স্মরণযোগ্য। দেখতে হবে সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ কি বাংলাদেশে বিদ্যমান রয়েছে? রয়েছে কি শুধু মেধা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে সুসংগঠিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা? নির্বাচন কমিশন তৈরি হয়েছে বটে; কিন্তু তার ক্ষমতা ও নিরপেক্ষতার পরীক্ষার ফল প্রশ্নবিদ্ধ। সন্ত্রাস রোধে দেশে স্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলা পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য শক্তিশালী এবং নিরপেক্ষ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে কি? ধরে নিলাম সব ঠিক আছে। তারপরও দৃষ্টি দিন নির্বাচনের সময়ের দিকে। কিছু ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে না নিলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিছুতেই সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হবে না; কারণ নির্বাচন তো এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা- তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিবন্ধকতা কী তা-ই ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপির জনসভায় পুনর্বার উত্থাপিত হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিরপেক্ষতার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো সব ক্ষেত্রে সবার সমান সুযোগ। এই সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া। সংসদীয় ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর দিকে তাকালেও অনুধাবনে এতটুকু অসুবিধা হবে না, যে সংসদ বা প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তা পূর্বাহেপ্তই ভেঙে দেওয়া হচ্ছে; কেননা যারা এ সংসদের সদস্যপদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাদের কেউ কেউ সদস্য হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন আর কেউ কেউ একেবারে নতুন। উভয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা অসম ও অগ্রহণযোগ্য। বিশ্বে উল্লেখযোগ্য সংসদীয় ব্যবস্থার কয়েকটি দেশের দিকে তাকান, তাহলেই সব সুস্পষ্ট হবে।
বিশেষ করে বাংলাদেশের আগামী দিনের সুস্থ এবং সৃজনশীল রাজনীতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করতে পারেন জাতীয় সংসদ ভেঙে দিতে। ফলে নির্বাচনের ক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড যেমন নিশ্চিত হবে, ঠিক তেমনি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলের সদস্যদের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনও সম্ভব হবে। এ পদক্ষেপ শুধু বর্তমানের জন্য শুভ হবে না, ভবিষ্যতের জন্যও হবে একটি মাইলফলক। রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণের জন্যই তো সংবিধান। এ লক্ষ্যে যদি সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হয়, তাহলে তা করতে আপত্তি থাকবে কেন? গণতন্ত্র শুধু এক ধরনের শাসন ব্যবস্থা নয়। গণতন্ত্র এক ধরনের নৈতিকতাও। এক ধরনের পরিশীলিত কর্মপ্রবাহ। রুচিকর ও সবার চোখে গ্রহণযোগ্য যৌথ উদ্যোগ। পরিচ্ছন্ন ও সচেতন কল্যাণমুখী একটি কর্মকাণ্ড। গোপনীয়তার জমাট বাঁধা অন্ধকার ছাপিয়ে গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের সূচনা হয় সর্বসাধারণের সমক্ষে, মুক্ত আলোয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মান অনেক অবনত। সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধমে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য শুধু একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট নয়, যদিও তা অপরিহার্য। এর কয়েকটি কারণও রয়েছে। নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনই সর্বেসর্বা; কিন্তু তৎকালীন সরকার হলো এর সহযোগী শক্তি। এই সহযোগী শক্তি যদি নির্মোহ না হয়, জনআস্থা অর্জনে সমর্থ না হয়, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি কিংবা প্রত্যাশা থেকে যাবে অপূর্ণ। গণতন্ত্রে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি শুধু রাজনৈতিক দলের নয়, এ দাবি জনগণেরও।