এস এম মেহেদী হাসান,স্টাফ রিপোর্টার//
২০০৪ সালে আরবান স্টাডি গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা শহরে অবস্থিত আড়াই হাজার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার একটি তালিকা তৈরি করে তা সংরক্ষণের জন্য রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, ডিসি অফিস, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে জমা দেয়। কিন্তু সেই তালিকাটি উপেক্ষিত হয়। ২০১২ সালে হেরিটেজ সংরক্ষণের দাবিতে উচ্চ আদালতে একটি রিট করা হলে আদালত ঐতিহ্যবাহী ভবনের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা সংশ্লিষ্টদের জমা দিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছরেও সেই তালিকা আদালতে জমা দেয়া হয়নি। বরং ২০০৯ সালে ৯৩টি ঐতিহ্যবাহী ভবনের তালিকা নিয়ে একটি গেজেট প্রকাশ করা হলেও ২০১৮ সালে এসে হেরিটেজের সংখ্যা কমিয়ে ৭৫টি করা হয়েছে। যদিও ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর ঢাকায় ২ হাজার ৭৯৩ ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও ভবনের তালিকা সরকারের কাছে জমা দেয় আরবান স্টাডি গ্রুপ। তবুও রহস্যজনক কারণে এই সংখ্যা ক্রমাগতভাবে শুধুই কমছে।
ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ক্রমাগত কমে যাওয়ার কারণে হাইকোর্টে আরবান স্টাডি গ্রুপ-ইউএসজি একটি রিট দায়ের করে। দায়েরকৃত রিটে ১৪ আগস্টের আদেশে ঢাকার সব সংরক্ষিত ও অসংরক্ষিত ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ভাঙার অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে রাজউকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি তারিক ইল হাকিম এবং বিচারপতি মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, সংশোধিত তালিকা প্রকাশের আগে ইউএসজি প্রণীত তালিকার স্থাপনাসমূহে কোনো ধরনের পরিবর্তন এবং অপসারণ করা যাবে না। সেই সঙ্গে আগামী তিন মাসের মধ্যে ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের একটি তালিকা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদেশে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার একটি সংশোধিত তালিকা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চর্চা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কেন্দ্রের পরিচালক মো. আজিম বকস বলেন, সংস্কারহীন হেরিটেজের নিচে চাপা পড়ে মরার উপক্রম হয়েছে ঢাকাবাসীর। কারণ অধিকাংশ স্থাপনাই ঝুঁকিপূর্ণ। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণের নামে একটি কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি কমপক্ষে ১০ লাখ করে টাকা উৎকোচ নিয়ে তবেই হেরিটেজ সংক্রান্ত বাড়ি সংস্কারের অনুমতি দিচ্ছে। আর যারা টাকা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের ভাগ্যে অনুমোদন মিলছে না।
পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজার এলাকায় হেরিটেজভুক্ত একটি বাড়ির মালিক শৈলেন সেন বলেন, নিজের বাড়িতে পরবাসীর জীবনযাপন করছি। পৈতৃক বাড়িতে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সম্পূর্ণ বাড়ি নিয়ন্ত্রণ করছে রাজউক।
আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান স্থপতি তাইমুর ইসলাম বলেন, রাজউক ও নগর উন্নয়ন কমিটির এক প্রকার মৌন সম্মতিতেই এসব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা প্রকাশ্যে ধ্বংস করা হয়েছে। বিনিময়ে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। ভবন ধ্বংসের প্রতিটি ঘটনা সংশ্লিষ্টদের জানানোর পরও তারা এগিয়ে আসেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ঢাকার ঐতিহ্য রক্ষার নামে চলছে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি। হেরিটেজ রক্ষার নামে গঠিত নগর উন্নয়ন কমিটির বিরুদ্ধে নানা অসঙ্গতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীরা জানান, ব্যক্তিমালিকানাধীন যেসব বাড়ি হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে তা গত কয়েক বছর ধরে সংস্কারের অনুমতি দিচ্ছে না নগর উন্নয়ন কমিটি। সম্প্রতি মোটা অঙ্কের উৎকোচ নিয়ে গোপনে কয়েকটি বাড়ি সংস্কারের অনুমতি দিয়েছে কমিটি। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ১৮টি ঐতিহ্যবাহী বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে বহুতল আলিশান ভবন।গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব ও হেরিটেজ রক্ষায় গঠিত নগর উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান মো. শহীদ উল্লা খন্দকার বলেন, নীতিগতভাবেই কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ হেরিটেজ ভবনের সংস্কারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি ৬৭ নম্বর পাটুয়াটুলী লেনের একটি ঐতিহ্যবাহী বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু করলে এ ব্যাপারে রাজউক ও স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করা হলেও ভাঙার কাজ থামেনি। বরং এ ক্ষেত্রে নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন রয়েছে বলে জানা গেছে। একইভাবে কমিটির কাছ থেকে সংস্কারের অনুমোদন নিয়ে শাঁখারী বাজারের ১৪ নম্বর ঐতিহ্যবাহী ভবনটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে দখলদাররা। সেখানে এখন বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিকিকিনি চলছে। শাঁখারী বাজারের ৬৫ নম্বর ভবনটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানেও হচ্ছে আলিশান ভবন।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, ভবন সংস্কারের অনুমোদন নিয়ে অনেকে পরে সেটি ভেঙে ফেলে কিংবা বিকৃত করে নতুন ভবন নির্মাণ করছে। আর এসব অনুমোদন তারা পাচ্ছেন অর্থের বিনিময়ে। আবার যাদের প্রকৃতপক্ষে ভবন সংস্কারের প্রয়োজন তাদের অনেককেই অনুমতি দেয়া হচ্ছে না উৎকাচ না দেয়ায়।
শাঁখারী বাজারের শম্ভুনাথ সাহা বলেন, মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে নগর উন্নয়ন কমিটি থেকে ভবন সংস্কারের অনুমোদন এনে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা খ্যাত পুরনো ভবন সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
একইভাবে রাজধানীর ৩৮ নম্বর টিপু সুলতান রোডের শঙ্খনিধি হাউসের ঐতিহ্য, পুরান ঢাকার উত্তর মৈশুণ্ডির ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯ ও ৪০ নম্বর হোল্ডিংজুড়ে ২৫ কাঠা জমির ওপর অবস্থিত হেরিটেজভুক্ত হিন্দু জমিদারবাড়ি ও মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন নেয়া হয়েছে। ভেঙে ফেলা অন্য হেরিটেজভুক্ত স্থাপনার মধ্যে রয়েছে ২০৭ লালমোহন সাহা স্ট্রিটের একটি ভবন, লালবাগ ২৫৫ ও ২৫৬নং হোল্ডিংস্থ জমিদার কেদার নাথের বাড়ি ও নাট মন্দির, ২৬ বিকেদাস ও ৩৩ প্যারিদাস রোডে অবস্থিত তিনটি ঐতিহ্যবাহী বাড়ি, আরমানিটোলা নিকি সাহেবের বাড়ি, রাজারাম মোহন রায় লাইব্রেরি, খামার বাড়ি ভবন, পুরনো জেলা পরিষদ ভবন।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, সুষ্ঠু নীতিমালার অভাবে এই অমূল্য সম্পদ রক্ষা করা যাচ্ছে না। এই অমূল্য সম্পদ রক্ষা করে ইতিহাস ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
রাজউকের চেয়ারম্যান ও নগর উন্নয়ন কমিটির সদস্য সচিব প্রকৌশলী মো. আব্দুর রহমান বলেন, নতুন গেজেটে পুরান ঢাকার কয়েকটি সংরক্ষিত সড়ককে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। হেরিটেজ ঘোষিত স্থাপনার মালিকদের দাবির ভিত্তিতেই এই নতুন গেজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংস্কারের অনুমতির নামে অর্থ আদায়ের বিষয়টি তিনিও অস্বীকার করেন।