দাবি মাত্র রেনকোট, মিলবে কি?

নুরুল মোহাইমেন মিল্টন, সিলেট থেকে
এই যুগেও মজুরি ৬৯ টাকা। আর সেই মজুরির জন্য ঝড় নেই বাদল নেই চা বাগানে কাজ করে চলেন শ্রমিকরা যাঁদের একটা বড় অংশ নারী। তাঁরা কাজ করেন বাগানে, চা গাছের পরিচর্যা, চা পাতা তোলা আর আরো অনেক কাজ। আয়েশী মধ্যবিত্তের হাতে তাঁদের নাম জুটেছে বড় সুন্দর – ‘দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি’র মেয়ে। তাতে চা বাগানের সবুজ সুন্দর ছবিটিই ফুটে ওঠে আর চাপা পড়ে যায় শ্রমিকদের বঞ্চনার জীবন, প্রজন্ম পেরিয়ে একই ধারায় চলে আসছে যেই শোষণ।
‘বাবু পেটের দায়ে মেঘ-বৃষ্টি, ঝড়-তুফানেও কাজ করছি। পাতি না তুললে হাজরি পাব না। আর হাজরি না পেলে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে কী খাব? এত কষ্টে আমরার দিন চলে,’ কথাগুলো আদামা তেলীর। ডানকান ব্রাদার্সের শমশেরনগর চা বাগানের এই নারী শ্রমিকের কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ে।
অনাহার, অর্ধাহার, দুঃখ-কষ্ট যাদের নিত্য সঙ্গী চা বাগানে নিয়োজিত এই শ্রমিকদের বাস্তবিক জীবনচিত্র যে কত কঠিন তা চোখে দেখলেই একমাত্র বোঝা সম্ভব। মহিলারা সকাল থেকেই পাতা ওঠানোর কাজে লাগেন। দুপুরে খাবার তাঁরা খান রুটি আর কচি চা পাতার চাটনি। যেদিন চা বাগানে
গিয়েছি সেদিনটা ছিল ঝড় আর বৃষ্টি। কিন্তু তাতে কি কাজ বন্ধ থাকে। দেখলাম নারী শ্রমিকরা মাথায় বাঁশের তৈরী ছাতা লাগিয়ে আর গায়ে পলিথিন জড়িয়ে পাতা ওঠাচ্ছেন। কথা বলি মিরা রেলী, স্বর্ণা মাঝি, লক্ষ্মী রবিদাস আর সন্ধ্যা রিকিয়াশনের সঙ্গে। ‘বৃষ্টি আর বাতাসে শরীরে ঠাণ্ডা লাগছে। কতক্ষণ বসে থাকব? সময় চলে যাচ্ছে। পাতি তুলতে না পারলে তো মজুরি মিলবে না। ঘরে সন্তানরা আছে। কী খাবে?’
আরো বললেন বৃষ্টির এ মৌসুমে বাগানে ‘লম্বরে’ অর্থাৎ টিলায় সাপ, জোঁক আর বিষাক্ত পোকামাকড়ের উৎপাত অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু তার মধ্যেও তাঁদের কাজ করতে হয়। হাতের আঙুল ব্যথা হয়ে যায় পাতি তুলতে তুলতে কিন্তু অবসর মেলে না। পুষ্টির অভাবে রোগশোক নিত্যসঙ্গী তাঁদের অথচ পয়সার অভাবে ঠিকমতন চিকিৎসাও করাতে পারেন না।
‘নারী শ্রমিকরা ৬৯ টাকা মজুরির বিনিময়ে চা বাগানের কঠিন শ্রম করে যাচ্ছেন। ঝড়-বাদলের সময় তাঁদের যে কষ্ট করে কাজ করতে হয় তা বলা মতো না। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দিনমান পলিথিন জড়িয়ে থাকার ফলে এলার্জি আর আরো নানা সমস্যা হয়,’ বললেন স্থানীয় ইউপি সদস্য ও চা শ্রমিক নেতা সিতারাম বিন। আর সেসব সমস্যা থেকে বাঁচতে তাঁরা নারী শ্রমিকদের জন্য মালিকদের কাছে রেইনকোট দাবি করেছেন।
একুশ শতকে এসেও আমাদের শ্রমিকরা কোথাও ৬৯ টাকায় দিনমজুরি করছে এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আর সেই ঘটনা ঘটছে আমাদের চা বাগানগুলোতে যেখানকার শ্রমিকদের কষ্ট আর লাঞ্ছনার কথা আমরা সকলেই কমবেশি জানি। শত শত একর বাগানের মালিকরা চা শ্রমিকদের কল্যাণে আজ পর্যন্ত কিছু করেছেন এমন শোনা যায়নি। রেনকোটের মতো সামান্য দাবিও তাঁরা মানবেন কিনা কে জানে।