বিলুপ্তির পথে দেশীয় জাতের ধান

0
(0)

নুরুল মোহাইমেন মিল্টন, সিলেট থেকে

হাওড়-বাওর, নদীনালা, খালবিল প্রকৃতির অপার সম্ভাবনাময় কৃষি প্রধান বাংলাদেশে এক সময়ে শোনা যেত গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছের কথা। নদী, হাওড়, খাল-বিলে আগেকার দিনে যেমনি মাছের রাজত্ব ছিল, তেমনি পাহাড়, টিলা আর জঙ্গলে গবাদি পশুর বিচরণ আর ক্ষেতে খামারে সোনালী ফসল উৎপাদনকারী কৃষকদের গলা ভরা ছিল গান। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানে যেমনি কৃষি ক্ষেতে তেমনি মাছ আর গবাদি পালনেও এসবের মিল খুঁজে পাওয়া খুবই দুরুহ ব্যাপার। উচ্চফলনশীল চাষাবাদের ফলে কৃষির উপর নির্ভরশীল আমাদের কৃষকদের কাছ থেকে প্রকৃতি-পরিবেশ এবং মৃত্তিকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দেশীয় প্রজাতির ধানবীজের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।

বিদেশী প্রজাতির হাইব্রীড বীজ, কৃষিজমি হ্রাস, কলের লাঙল, গোখাদ্যের অভাব আর রোগ-বালাই কৃষকদের দুর্দিন বয়ে আনছে। বিজ্ঞানের আর্শিবাদে অধিক ফলনের আশায় হাইব্রীড চাষাবাদে নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বাংলার মাঠে ঘাটে স্বাদে গন্ধে ভরা প্রকৃতিবান্ধব ৫০টির বেশি দেশীয় প্রজাতির ধান রয়েছে বিলুপ্তির পথে। অথচ দেশীয় প্রজাতির ধান অনেক সময় মানবদেহের জন্য উপকারী। গ্রাম বাংলার কৃষক সাধারণ অদম্য আগ্রহ সহকারে দেশীয় প্রজাতির ধান চাষাবাদে উৎসাহী ছিলেন। বিভিন্ন প্রজাতির ধান চাষের জন্য জমিও ছিল। কম উৎপাদন খরচে স্বাদে গন্ধে ভরা মানবদেহের উপকারী ধান দিয়ে বিয়ে, অনুষ্ঠানাদিতে বিরিয়ানি, পিঠা-পায়েস তৈরী হতো। বর্তমানে এসব প্রজাতির ধান খুঁজে পাওয়াও কষ্টকর। উচ্চফলনশীল ধান চাষে কৃষকদের আগ্রহী করে তোলায় বৃহত্তর সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রকৃতিবান্ধব ধানের জাতগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। এসব জাতের মধ্যে আউশ মৌসুমের রয়েছে বাউরস, কাসালত, চেংরি, মুরালী, দুমাই, বোরো মৌসুমে- খইয়াবোরো আর টেপিবোরো। আমন মৌসুমে আছে বালাম, লাটি সাইল, নাইজার সাইল, প্রসাদবুক, ময়না সাইল, কার্তিক সাইল, কালিজিরা, পুঁটি বিরন, লাটিয়াইল বিরন, মৌবিরন, ভাগ্যেস্বরী, মধুমালতি, নি-ধান ও জামাইলাড়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের হারিয়ে যাওয়া প্রজাতির মধ্যে গৌরিকাজল, লক্ষ্মীণতা, নোড়াই সাটো, পরাঙ্গিদীঘা, হাসবুয়ালে, ভোরানটা, মানিকদীঘা, খৈয়ামটর, দলকচু, পঙ্খীরাজ, বাঁশিরাজ, ঝিঙেঝাল, দেবমণি, দুধমণি, কালাবায়রা, ধলাবায়রা, গন্ধকোস্তের, আশ্বিন দীঘা, আশ্বিন মালভোগ ও দুধকলম উল্লেখযোগ্য।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মোবাশ্বির আলীর ধানচাষে সুনাম আছে। তাঁর সাথে এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল একদিন। ‘বিদেশী প্রজাতির হাইব্রীড চাষে কৃষকদের অত্যধিক পরিশ্রম ছাড়াও সার, কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ বেড়ে যায়। হাইব্রীড চাষে পোকার আক্রমণও থাকে বেশি। তাছাড়া যে পরিমাণ সার, কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় ও শ্রম দিতে হয়, যদি দেশী উন্নত জাতের চাষাবাদে এই শ্রমঘাম ও পরিমাণমতো সার প্রয়োগ করা হয় তাহলেও অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব ছিল।’ কৃষকদের ধারণা থেকে সহজেই যে বিষয়টি অনুধাবন করা সম্ভব সেটি হচ্ছে, বিদেশী প্রজাতির উচ্চফলনশীল ধান চাষের চেয়ে প্রকৃতিবান্ধব দেশীয় প্রজাতির এসব ধান চাষে রয়েছে অনুকূল পরিবেশ। সমতল ভূমি ছাড়াও উচুঁ-নিচু ঢালু জমি, বন্যার পানি অথবা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়া জমিতেও চাষের জন্য উপযুক্ত ধান রয়েছে। খইয়া বোরোর মতো অনেক প্রজাতি রয়েছে যা কয়েক ফুট পানির ওপর ভেসে মাথা উচুঁ করে অনায়াসেই থাকতে পারে। মৌসুমের শুরুতে জমি তৈরী করে বীজ বপনের পর সার, কীটনাশক, সেচ ও নিড়ানির প্রয়োজন নেই বললেই চলে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী থাকায় পোকামাকড়েরও আক্রমণ কম থাকে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের তেমন প্রয়োজন না থাকায় আবাদি জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায় না।

উচ্চফলনশীল চাষে তুলনামূলক বেশী ফলন হলেও এই চাষাবাদ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাছাড়া উচ্চফলনশীল ধান অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি-পরিবেশ এবং মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় যা বিভিন্ন্ পরিবেশকর্মীরা বিশেষ করে বলে থাকেন। ২০০৯ সালে কুড়িগ্রাম, পটুয়াখালীসহ দেশের কয়েকটি এলাকার হাইব্রীড ধানের চাষাবাদ সংক্রান্ত নানা নেতিবাচক খবর পাওয়া যায়। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাইব্রীড চাষ করে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এমন ঘটনাও পত্রিকায় এসেছে। হাইব্রীড ধানের বীজ কৃষক নিজে উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারেন না। সেই বীজ দিয়ে চাষ করার পর কৃষক নিজে বীজ রাখতে পারেন না। পরবর্তী মৌসুমে কৃষকদের আবার চড়া দামে কোম্পানীর বীজ কিনতে হয়। পরের বছর জমিতে আরো অধিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। ফলে আবাদি জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায় এবং আবাদের খরচ বছর বছর বাড়তেই থাকে। উৎপাদন খরচ বেশী হলেও বাজারদরে কৃষকরা কম পান। এরকম অবস্থায় কয়েক বছর ধারাবাহিক হাইব্রীড ধানের আবাদ করার পর কৃষকের ঘরে অবশিষ্ট বীজ না থাকলে কৃষক সাধারণ বীজের অধিকার হারাতে বসবে।

হাইব্রিড ধানের গুণগত মান নিয়েও দেশব্যাপী নানা প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল হাইব্রিড ধান চাষের উপযুক্ত নয়। তবে গবেষণার মাধ্যমে দেশীয় সব বীজকে ক্রমাম্বয়ে উচ্চফলনশীল বীজে রূপান্তরিত করতে পারলে খাদ্য উৎপাদনের ঘাটতি হবে না। ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন প্রদেশে হাইব্রিড নয় বরং দেশীয় বীজগুলিকে বাঁচিয়ে অধিক উৎপাদনের চেষ্টা চলছে। আগামীতে খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় পারিপার্শ্বিক এসব পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ব্যয়বহুল চাষাবাদের পরিবর্তে আমাদের প্রকৃতিবান্ধব দেশীয় উচ্চফলনশীল জাত ব্যবহারে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে চাষিদের সরকারিভাবে বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিতরণ ও জাত নির্বাচনের জন্য সহায়তা দিলে উচ্চফলনশীল জাতের পাশাপাশি প্রতিকূলতা মোকাবেলার সামর্থ্যযুক্ত বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির ধানের চাষ বাড়বে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.