0
(0)

আবদুল্লাহ আল নোমান//
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সুরে সুরে তাল মিলিয়ে ঈদের আনন্দকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে একসময় বিভিন্ন ধরনের আবেগময় বার্তা লিখে, তাদের মনের গভীরের কথা-বার্তা দিয়ে সাজিয়ে বিলিয়ে দেয়া হতো ঈদ কার্ড। শহরের অলিতে-গলিতে ও গ্রাম-গঞ্জে বসত ছোট ছোট ঈদ কার্ড বিক্রির দোকান। ছোট থেকে বড় সবাই কিনত এই ঈদ দাওয়াত কার্ড। আর সবাই এর মধ্যে মনের মাধুরী মিশিয়ে আবেগময় বার্তা লিখে পৌঁছে দিত প্রিয়জনের কাছে। সেই ঐতিহ্য আজ ধীরে ধীরে হারাতে বসেছে।
ঈদের সময় এলে এক সময় বাংলাবাজারের ঈদ কার্ড ব্যবসায়ীরা কাপড়ের ব্যবসায়ীদের চেয়েও বেশি ব্যস্ত সময় কাটাতেন। ঈদ কার্ড তার ঐতিহ্য হারানোর ফলে ব্যবসায় দেখা দিয়েছে মন্দাভাব। তাই অনেকে ব্যবসা ছেড়ে চলে গেছেন। আবার অনেকে ব্যবসার ধরন পরিবর্তন করেছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদ কার্ডের ব্যবসা এখন খারাপ। তবে বিবাহ কার্ডের ব্যবসা করে তারা মোটামুটিভাবে চালিয়ে নিচ্ছেন তাদের জীবন। একটা সময় আবেগ ভালোবাসার বার্তায় ঈদ কার্ডের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানাত প্রিয়জনদের। সময়ের বিবর্তনে আমরা এখন এনালগের সীমানা পেরিয়ে ডিজিটাল যুগে বসবাস করছি। সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা প্রকাশের রীতিও। রমজান এলে নতুন জামা-জুতার পাশাপাশি জমে উঠত ঈদ কার্ডের বাজার।
বন্ধু-বান্ধব, প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা সুসম্পর্ক আছে এমন মানুষদের ঈদ কার্ড পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানাত, কিন্তু কালক্রমে ই-কার্ডের ধাক্কায় হারিয়ে যাচ্ছে এই রীতিটা। এখন মোবাইলে এসএমএস ছাড়াও সামাজিক মাধ্যমে ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়ে থাকে, তবে ই-কার্ডের শুভেচ্ছা বার্তায় ঈদ কার্ডের মতো ভালোবাসা ও আন্তরিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায় না বলে অনেকে মনে করেন।
একটা সময় ঈদ এলে পাড়া, মহল্লার অলিগলিতে, গ্রামে গ্রামে, ঈদ কার্ডের দোকান দেখা যেত, এখন আর এ ধরনের দোকান চোখে পড়ে না। এ কার্ডগুলোতে মসজিদ, মক্কা, কাবা-শরিফ, ফুল, পাখিসহ তারকাদের ছবি থাকত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শরিফুজ্জামান মুন্না জানান, তারা ক্লাস সিক্স-সেভেনে থাকতে ২-৫ টাকা দিয়ে ঈদ কার্ড কিনে বন্ধুদের দাওয়াত দিত। সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনের মাধমে কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে ঈদ কার্ডের সংস্কৃতি।
বাংলাবাজারের পাইকারি দোকানদাররা জানান, আগে রমজানে প্রতিদিন তার ১-২ লাখ টাকার কার্ড বিক্রি হতো এখন হয় মাত্র ১-২ হাজার টাকা, তিনি এর জন্য মোবাইল ফোনকে দায়ী করেন। প্রযুক্তি আমাদের দিচ্ছে বেগ তবে কেড়ে নিচ্ছে আবেগ, প্রযুক্তির বহু ব্যবহারে এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের বহু সংস্কৃতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঈদ কার্ডের প্রচলন অনেকটাই কমে গেছে। গত কয়েক বছর আগেও ঈদ কার্ড ছাড়া যেন আনন্দই জমতো না ঈদের। শত অভিমান দানা বাঁধত মনের মাঝে। অথচ কালের পরিক্রমায় আবহমান গ্রামবাংলার এ সংস্কৃতিটি হারিয়ে গেল ইন্টারনেট, প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষও যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। কার্ড কিনে নিজের হাতে ২ লাইন লেখার চেয়ে মোবাইলের কি-প্যাড আর কম্পিউটারের কি-বোর্ডে লিখতেই সবাই এখন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
মোবাইলের মেসেজ অপশনে গিয়ে একটি মেসেজ লিখে সবাইকে ফরওয়ার্ড করা অথবা ফেসবুকে একটি ঈদ মোবারক লেখা ছবিতে সবাইকে ট্যাগ করে দেয়াটা বর্তমানে ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে রমজানের মধ্যভাগ থেকে শুরু হতো ঈদ কার্ড বেচাকেনার ধুম। নানান ডিজাইন, প্রচ্ছদ আর পছন্দসই রঙের মাঝে খুঁজে নিত প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জানানোর মজাটা। অথচ সময়ের ব্যবধানে নিষ্প্রাণ হয়ে গেল ঈদ কার্ড প্রথা। রাজধানী পুরান ঢাকার অলিগলিতে এক সময় বসত ঈদ কার্ডের দোকান। যা এখন বিরল।
গত কয়েকদিন পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকটি স্থানে ঈদ কার্ড বিক্রি হচ্ছে। এদিকে আইডিয়াল প্রোডাক্টের ক্যাশিয়ার মুসলিম উদ্দিন বলেন, আজকে মাত্র ৪টি ঈদ কার্ড বিক্রি করেছি। ঈদ কার্ডের মার্কেট এখন নাই বললেই চলে। পাকিস্তান সময়ের এই দোকানটি এক সময় ঈদ এলেই জমে উঠত আনন্দের মেলায়। যা বর্তমানে তা হারাতে বসেছে। এমন এক সময় ছিল যখন শুধু ঈদ কার্ড বিক্রি করে অনেক বেকার যুবক আর্থিকভাবে সচ্ছল হতো। কিন্তু বর্তমানে সেদিন আর নেই, এসেছে মোবাইল ফোন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এসএমএসের মাধ্যমে প্রিয়জনের কাছে মনের কথা পৌঁছে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাকিব নামের এক তরুণ বলেন, এতো সময় কই? মোবাইল এসএমএস দিলে খরচ কম এবং অনেক দূরপ্রান্তে তা পৌঁছানো সহজ। অন্যদিকে ভিন্ন কথা জানিয়েছেন ঐতিহ্যবাহী আজাদ প্রডাক্টের ব্যবস্থাপক শাহিন। তিনি বলেন, তাদের বিক্রি ব্যক্তি পর্যায়ে খারাপ হলেও অফিসিয়াল পর্যায়ে ভালো চলছে। রোববার তারা প্রায় ২ হাজারের মতো ঈদ কার্ড বিক্রি করেছেন। তবে আগের মতো ঈদ কার্ড এখন এই প্রযুক্তির যুগে চলে না বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.