গ্যাসের তীব্র সংকট রাজধানীতে

মাইফ আহসান জেমো ঢাকা প্রতিনিধি॥
দফায় দফায় দাম বাড়ালেও কোনো কিছুতেই যেন সংকটের সমাধান মিলছে না। রমজানের শুরুতেই রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় চলছে গ্যাসের তীব্র সংকট। এর মধ্যে আছে বিদ্যুতের কমবেশি লোডশেডিংও। আর তাই রমজানের শুরুতেই সেহরি-ইফতারিতে নগরবাসীকে পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি।
বাসায় আছে গ্যাসের সংযোগ। কিন্তু কখনো টিমটিম করে জ্বলে চুলা। আবার কখনোবা গ্যাস একদম হাওয়া, তাই বাধ্য হয়েই বন্ধ রাখতে হচ্ছে রান্নাবান্না। যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর কিংবা পুরান ঢাকা- রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায়ই থাকছে না গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ। পাশাপাশি পুরো শহরেই আবারো ফিরে এসেছে লোডশেডিং। আর এসব কারণেই চলতি রমজানে গ্যাস-বিদ্যুতের মতো জরুরি সেবা নিয়ে দুশ্চিন্তার কমতি নেই নগরবাসীর।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর-আদাবরের বেশ কিছু এলাকায় গ্যাস সমস্যা প্রকট। সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা অবধি গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না এসব এলাকায়। এ সময় গ্যাসের চুলা নিভু নিভু জ্বললেও তাতে রান্না করা যাচ্ছে না।
ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর উভয় সিটি কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে লালবাগ, আজিমপুর, শুক্রাবাদ, সূত্রাপুর, খিলগাঁও, গেন্ডারিয়া, শান্তিনগর, মিরপুর, কুড়িল, হাতিরপুলসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের তীব্র সংকট চলছে।
সূত্রাপুর পাঁচভাই ঘাট লেনের বাসিন্দা আফজাল হোসেন জানান, রমজানের প্রথম দিন সকাল থেকেই লাইনে গ্যাস নেই। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন গ্যাস আসেনি তখন কেন্দ্রে অভিযোগ করেন। তারা আপাতত কোনো সমাধান নেই বলার পর নিরুপায় হয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দা এক নিকটাত্মীয়ের বাসা থেকে খাবার রান্না করিয়ে এনেছেন বলে জানান।
এদিকে কেউ কেউ রান্না করতে না পেরে হোটেল থেকে খাবার কিনে এনে খেয়েছেন বলেও ফেসবুকে লিখেছেন।
গ্যাসের এমন সংকট নিয়মিত হয়ে পড়ায় বিরক্ত এখানকার বাসিন্দারা। মোহাম্মদপুর চানমিয়া হাউজিং এলাকায় গৃহিণী শামসুননাহার বলেন, সকাল থেকে গ্যাস থাকে না। নাস্তা তৈরি করা যায় না। নাস্তা বানাতে হলে ভোর রাতে উঠে পড়তে হয়। আবার দুপুরে যে রান্না করব সে উপায়ও নেই। সকালে গিয়ে গ্যাস আসছে বিকেলের দিকে। এ কারণে ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেক সময় বাইরে গিয়ে খাবার খেতে হচ্ছে।
একই অবস্থা মোহাম্মদীয়া হাউজিং, নবোদয় হাউজিং, সেখেরটেক, আদবর, শ্যামলী হাউজিং, ঢাকা হাউজিং, মুনসুরাবাদ এলাকার বেশ কিছু জায়গায়। এসব এলাকায় দুপুরের আগে গ্যাস না আসায় অনেকেই আগের দিন রাতেই রান্না করে রাখছেন পরদিন দুপুরের খাবার।
আদাবর ১০ নম্বর রোডের বাসিন্দা সুমি আক্তার বলেন, আগের দিন রাতে রান্না করে রাখি। সেটাই পরদিন দুপুরে খেতে হয়। খাবারটা যে গরম করে খাব, সে উপায়টাও নেই।
শুক্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা গণমাধ্যমকর্মী মো. টিপু বলেন, ‘রমজানের শুরু থেকেই গ্যাস থাকছে না। তাই এলাকার বাসাবাড়িতে রান্নাবান্না করতে পারছেন না কেউই। এলাকাবাসী অনেকেই এখন প্রায় হোটেল নির্ভর হয়ে গেছে। অথচ আমরা ঠিকমতো গ্যাস বিল পরিশোধ করি। এই অবস্থা চলতে থাকলে ইফতারি-সেহরি কীভাবে করব চিন্তায় আছি।’
যদিও নগরীর সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বরাবরের মতো রমজান নিয়েও শোনাচ্ছে আশার বাণীই। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চলতি মাসেই জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে বিতরণ সক্ষমতাও।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান বলেন, যেসব লাইনগুলোতে অনেক চাপ সেগুলো বিভাজন করা হয়েছে। আশা করি রমজানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সমস্যা হবে না।
তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের আশ্বাস আর রমজানে ৬ ঘণ্টা সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখায় স্বাভাবিক থাকবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও আবাসিকে গ্যাস সরবরাহ। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব উদ্যোগে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও আবাসিকে গ্যাস সংকট কাটার তেমন সম্ভাবনা নেই।
নিয়মিত গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না কিন্তু বাধ্য হয়ে তিতাস ও সিলিন্ডার উভয়ের বিল গুনছেন, এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। মোহাম্মদীয়া হাউজিং এলাকার বাসিন্দা রেজাউল করিম জানান, দুপুর পর্যন্ত গ্যাস থাকে না, এটা এখন সবাই জানে। সমস্যা এক-দু’দিন মানা যায়। মাসের পর মাস একই অবস্থা। তাই বাধ্য হয়ে বাসায় একটা সিলিন্ডার নিতে হয়েছে। বাসায় বৃদ্ধ মা আছেন, বাচ্চারা আছে, তাদের কথা ভেবেই সিলিন্ডার নিলাম। আবার দু’দিকে বিল দিতে হচ্ছে বলে আর্থিক ক্ষতিরও মুখোমুখি হচ্ছি।
তিতাস গ্যাসের পরিচালক (অপারেশন) এইচ এম আলী আশরাফ বলেন, রমজান মাসে আমাদের সিস্টেমটা কিছুটা সহনীয় থাকবে এবং ইফতার ও সেহরির সময় গ্যাস সহনীয় পর্যায়ে থাকবে।
তবে জাতীয় গ্রিডে নতুন করে গ্যাস যুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আবাসিক গ্রাহকদের সংকট কাটার তেমন সম্ভাবনা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বাসা বাড়িতে যে গ্যাস সংকট আছে, সে অবস্থার কোনো উন্নতি হবে না সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখার কারণে। এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।
তবে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তেলভিত্তিক হওয়ায় আবারো বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের জরুরি গ্যাস নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, উত্তর ও জরুরি গ্যাস নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র- দক্ষিণের দুই রেডিও অপারেটর মো. আলমগীর ও মোশাররফ হোসেন জানান, তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্যাস সংকট সম্পর্কে শত শত অভিযোগ পেয়েছেন। প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন, চাহিদার তুলনায় গ্যাসের চাহিদা বেশি হওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে। মেইন লাইনে প্রেসার কম থাকায় গ্যাসের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।