দেশের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে বরিশালে

আবদুল্লাহ আল নোমান//
পরিবেশ এবং প্রকৃতিগত ৬২টি দিক বিবেচনায় উপযুক্ত হলে বরিশালের হিজলা উপজেলার হিজলা-গৌরবদী ইউনিয়নের মেঘনা নদীর তীরবর্তী চরমেঘায় নির্মিত হবে দেশের দ্বিতীয় পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের স্থান নির্ধারনে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গতকাল শনিবার চরমেঘা মৌজা পরিদর্শন করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয় এবং পরমানু শক্তি কমিশনের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দল। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর নির্মাণ শুরুর পরবর্তী ৫ বছরের মধ্যে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদন শুরু করতে পারবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিস্ট বিশেষজ্ঞরা।
দক্ষিণাঞ্চলে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট নির্মানের সম্ভাব্য স্থান সমীক্ষা প্রকল্পের পরিচালক ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএফএম মিজানুর রহমান জানান, চরমেঘায় প্রাথমিকভাবে দুটি ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রতিটি ইউনিটে ১২শ’ করে মোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে। ২ বছর ধরে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর স্থান নির্বাচন চূড়ান্ত হলে মূল অবকাঠামোর নির্মান কাজ শুরু হবে। অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শুরুর পরবর্তী ৫ বছরে ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন শুরু হবে।
দক্ষিণাঞ্চলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ সম্ভাব্যতা যাচাই দলের বিশেষজ্ঞ ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মুখ্য প্রকৌশলী ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. আব্দুর রাজ্জাক জানান, এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সর্বাধুনিক থার্ড জেনারেশন প্লাস প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। এতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে কোনো রেডিয়েশন (বিকিরণ) হবে না। এতে কোনো পরিবেশ দূষণ হবে না। এ কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৩শ’ গজের বাইরে জনবসতি থাকলেও কোনো ক্ষতি হবে না। বরিশালের জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জানান, প্রস্তাবিত স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণে নিষ্কন্টক অখণ্ড খাস জমি থাকায় জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে না এবং খাস জমি জমিতে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। একসঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাস জমি পাওয়ায় সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে।
বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ঘরে ঘরে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছে বর্তমান সরকার। এরই অংশ হিসেবে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ওইদিন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক নির্মাণ কাজ শুরুর সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণাঞ্চলে দেশের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দেন। প্রস্তাবিত ওই প্রকল্পের উপদেষ্টা করা হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালযের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীকে।
অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী জানান, প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘোষণার পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলে দ্বিতীয় পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রথমে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল) কোম্পানি গঠন করা হয়। এর পরই দক্ষিণাঞ্চলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। প্রকল্প গ্রহণের পর প্রাথমিকভাবে সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণের কাজ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৯ মার্চ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে বরিশালের জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি লিখে নদী-সাগরের তীরবর্তী এলাকায় প্রায় ২ হাজার একর জমির প্রাপ্যতা, জমির মালিকানা এবং জমি ব্যবহার সম্পর্কিত প্রাথমিক তথ্যাবলি জানতে চাওয়া হয়।
বরিশালের জেলা প্রশাসক গত ১১ এপ্রিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে প্রেরিত প্রতি উত্তরে হিজলার হিজলা-গৌরবদী ইউনিয়নের চরমেঘা মৌজায় ২ হাজার ২শ’ ৫৫.৯৬ একর খাস খতিয়ানভুক্ত জমি রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। ওই এলাকা নিষ্কন্টক অখণ্ড খাস জমি হওয়ায় এখনই প্রকল্পের কাজ শুরু করার যোগ্য, অধিগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা না থাকায় ওই জমিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের বিপুল অর্থ সাশ্রয়, প্রস্তাবিত জমিতে জনবসতি না থাকায় পুনর্বাসনের প্রয়োজন হবে না, প্রস্তাবিত এলাকায় কিংবা এর কাছাকাছি কোনো জনবসতি না থাকায় পরবর্তীতে কোনো অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা ঘটলেও জানমালের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা কম এবং প্রস্তাবিত প্রকল্প মেঘনা নদীর মূল প্রবাহের পাশে থাকায় ওই জমিতে সহজে নৌ যোগাযোগের ব্যাপক সুবিধা রয়েছে বলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত চিঠিতে উল্লেখ করেন জেলা প্রশাসক।
প্রকল্প বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকের প্রস্তাবিত জমিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের স্থান নির্ধারণের সম্ভাবতা যাচাইয়ে গতকাল সরেজমিন হিজলার চরমেঘা মৌজা পরিদর্শন করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং পরমাণু শক্তি কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল।
প্রকল্প পরিচালক ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএফএম মিজানুর রহমান জানান, রূপপুরে একই রকমের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সবশেষ প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। বরিশালের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রকল্প ব্যয় আরো বেশি হতে পারে। পরিবেশ এবং প্রকৃতিগত ৬২টি দিক বিবেচনা করে উপযুক্ত হলে তবেই চরমেঘায় এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হবে।