পিরোজপুরে স্বপ্ন জয়ী অদম্য পাঁচ নারী

0
(0)

হযরত আলী হিরু, পিরোজপুর প্রতিনিধি ॥
পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে অভাব, অনটন ও নানা ধরনের প্রতিকূলতাকে হার মানিয়ে স্বপ্নকে জয় করেছে পাঁচ নারী। নিজেদের মনবল আর অদম্য চেষ্টার ফলে আজ তারা স্বাবলম্বি। সমাজে নানা ধরনের উন্নয়ন মূলক ও সামাজিক কর্মকান্ডে তারা নিজেদেরকে সর্বদা আত্মনিয়োগ করছেন। স্বীকৃতিস্বরূপ এ পাঁচ নারীকে স্বরূপকাঠি উপজেলা প্রশাসন এবছর উপজেলা পর্যায়ে জয়িতা সন্মাননা প্রদান করেছেন।
১। শিল্পি খাতুন, (অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী)
উপজেলার সুটিয়াকাঠি এলাকার এ.এস.এম মালেক শাহিন এর স্ত্রী শিল্পি তার স্বামীর অভাব অনটনের কখা চিন্তা করে বেসরকারী এনজিও ব্রাক থেকে ক্ষুদ্র ঋন গ্রহন করে শুরু করলেন মরগীর ফার্ম ও নিজস্ব পুকুরে মাছ চাষ। স্বামীকে মেডিসিনের প্রশিক্ষন করিয়ে তাকে দিয়ে বাড়ির সামনে একটি ফার্মেসী খুলে দিলেন। ধীরে ধীরে শিল্পি আরও একটি মুরগীর ফার্ম ও কাঁচি রশির কারখানা শুরু করেন। বর্তমানে সেই কারখানায় নিজে এবং স্বামী ছাড়াও বেতনভুক্ত আরও তিন জন কর্মচারী রয়েছেন। তাকে দেখে ওই এলাকায় আরও কয়েকজন ওই ব্যাবসা শুরু করেছেন। তিনি গত ইউপি নির্বাচনে সুটিয়াকাঠি ইউনিয়নের সংরক্ষিত (৭,৮ ও ৯) নং ওয়ার্ডের মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন। গত ২২/০৩/২০১৭ তারিখ তিনি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা পদে নিয়োগ পেয়ে বর্তমানে সেখানে কর্মরত আছেন।
২। সিরিন আখতার (শিক্ষা ও চাকুরীতে সাফল্য অর্জনকারী)
উপজেলার জলাবাড়ি ইউনিয়নের কামারকাঠি এলাকার মো. হাবিবুর রহমানের স্ত্রী সিরিনের পিতা পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন। দশ ভাই বোনের মধ্যে সিরিন ষষ্ঠ। বড় সংসার হওয়ার কারনে প্রায়ই তিন বেলা পেটপুরে খেতেও পারতেন না তারা। ৮ম শ্রেনীতে পড়া অবস্থায়ই সিরিন প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালানোর পাশাপাশি বাবাকে সংসারে সহায়তা করতেন। নবম শ্রেনীতে পড়া অবস্থায় তার পিতা অবসরে গেলে সংসারে আরও অভাব অনটন নেমে আসে। পরে নিজের মেধা, পরিশ্রম ও অদম্য চেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে তিনি তার লেখাপড়াকে চালিয়ে গেলেন। এক পর্যায়ে তিনি বরিশাল বিএম কলেজ থেকে এম এ পাশ করেন। ১৯৯৭ সালে তার বিয়ে হয়। কিন্তু স্বামী ছোট একটি কোম্পানীতে সামান্য চাকরী করায় সংসার বেশ অভাবের মধ্যেই চলছিল। ২০০৩ সালে মধ্য জলাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পান। বর্তমানে তিনি পূর্ব কামারকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত।
৩। মোছা. আম্বিয়া খাতুন (সফল জননী)
৭ বছর বয়সে মা মারা যাওয়ার পরে ১৫ বছর বয়সে স্বরূপকাঠি সদর এলাকার আবু হাছান এর সাথে বিয়ে হয় আম্বিয়ার। স্বামী প্রথমে ৪৫ টাকা বেতনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং পরে ৫০ টাকা বেতনে পোষ্ট অফিসে চাকুরী করতেন। নিজে মাত্র ৫ম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও স্বপ্ন দেখেন তার ৬ ছেলেমেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার। চেষ্টার ফলে আজ তার বড় মেয়ে এম.এ.বি.এড পাশ করে বর্তমানে পশ্চিম সোহাগদল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে কর্মরত আছেন। মেঝ মেয়ে সহকারি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান পদে সরকারি মহিলা কলেজ বরিশালে কর্মরত আছেন। ছোট মেয়ে বিএ অনার্স এম.এ। বড় ছেলে এম.এ.বি.এড বিএম কলেজ বরিশাল। মেঝ ছেলে অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান সমাজকর্ম বিভাগ পদে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেটে কর্মরত। ছোট ছেলে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ইসলামী ব্যাংক, গৌরনদী টরকি শাখায় কর্মরত।
৪। হাসি বেগম (নির্যাতনের বিভিষিকা জয়ী)
উপজেলার কামারকাঠি এলাকার দরিদ্র ইব্রাহিম মিয়ার তিন সন্তাদের মধ্যে দ্বিতীয় হাসি। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। স্বামী ঢাকায় ফার্নিচারের দোকানে কাজ করার সুযোগে বিয়ের দুই বছরের মাথায় শশুর কর্তৃক ধর্ষনের শিকার হয় সে। পরে আইনের আশ্রয় নিয়ে স্বামীকে তালাক দেয় । একপর্যয়ে বেসরকারী এনজিও ব্রাক থেকে তাকে ২০ হাজার টাকা মুল্যমানের একটি সেলাই মেশিন ও সীট কাপড় দিয়ে পূর্নবাসনে সহায়তা করা হয়। বর্তমানে সে তাই দিয়ে স্বাবলম্বি, সে চায় তার মত এমন জগন্য নির্যাতনের শিকার যেন আর কারও না হতে হয়।
৫। বিউটি আক্তার (সামাজে উন্নয়নে অবদান)
উপজেলার স্বরূপকাঠি সদর এলাকার একেএম শফিকুর রহমানের স্ত্রী বিউটির জন্ম দরিদ্র একটি পরিবারে। আর্থিক অভাবের কারনে তার পিতা তাকে লেখাপড়া করাতে চান নি। প্রাইভেট পড়িয়ে তিনি নিজে নিজের পড়ালেখার অর্থ জোগাড় করতেন। ১৯৯৫ সালে তিনি এসএসসি পরিক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেন। এইচএসসি পরিক্ষার পূর্বে তার বিয়ে হয়। সমাজে দরিদ্র মানুষের শারিরীক সহায়তা প্রদান করার লক্ষে ব্রাকের পুষ্টিকর্মি হিসেবে যোগ দেন। এলাকায় ইভটিজিং, যৌতুক, নির্যাতন, বাল্য বিবাহ মাদক ও প্রসুতি মায়েদের সহায়তা বিষয়ের উপর বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তিনি উঠান বৈঠক করেন। তিনি স্বরূপকাঠি পৌরসভার সংরক্ষিত (১,২ ও ৩) নং ওয়ার্ডে দুই বার মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়াও তিনি উপজেলা মহিলা পরিষদের একজন সক্রিয় কর্মি।
এ ব্যাপারে স্বরূপকাঠি উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিসার নুসরাত জাহান বলেন এ পাঁচ জন নারী তাদের অদম্য চেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে তাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছেন। বর্তমানে তারা প্রত্যেকে সমাজের আইকন। তারা সমাজে নানা ধরনের জন সহযোগীতা মূলক কর্মকান্ডে অবদান রাখছেন। এদেরকে দেখে অন্যরাও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.