আলাদা করা হল শিশু তোফা-তহুরাকে

খোন্দকার মনিরুজ্জামান মনির ঃ

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকগন গতকাল মঙ্গলবার দীর্ঘ সাড়ে ৬ ঘণ্টার জটিল অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে সংযুক্ত শরীরে জন্ম নেওয়া দশ মাস বয়সী শিশু তোফা আর তহুরাকে আলাদা করতে পেরেছেন।

ওই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের তৃতীয় তলার অপারেশন থিয়েটারে ওইদিন সকাল ৮টায় অস্ত্রোপচার শুরুর পর বেলা আড়াইটার দিকে বেরিয়ে এসে শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ কানিজ হাসিনা শিউলি উপস্থিত সাংবাদিকদের এ খবর জানান।

তিনি বলেন, ওরা দুজন এখন আলাদা। দু’জনের অবস্থাই স্থিতিশীল। এখনও কিছু রিপেয়ারের কাজ বাকি আছে। আরও দুই-তিন ঘণ্টা সময় আমাদের লাগবে।

গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দহবন ইউনিয়নের কৃষক রাজু মিয়া ও তার স্ত্রী শাহিদা বেগমের যমজ সন্তানের জন্ম হয় জোড়া লাগানো শরীর নিয়ে।

তোফা আর তহুরার পিঠের দিক থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত মেরুদন্ডের হাড় সংযুক্ত ছিল। মাথা-হাত-পা আলাদা হলেও তাদের মলদ্বার ছিল একটি।

শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ শাহনূর ইসলাম জানান, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এমন ঘটনাকে ‘পাইগোপেগাস’ বলা হয়।

জন্মের ৮ দিনের মাথায় শিশু দুটিকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হলে প্রথমে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাদের মলদ্বার আলাদা করা হয়। দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষা ও প্রস্তুতির পর মঙ্গলবার সকালে তোফা ও তহুরাকে আলাদা জীবন দেওয়ার জন্য অস্ত্রোপচার শুরু করেন চিকিৎসকেরা।

সকালে অস্ত্রোপচার শুরুর পর হাসপাতালের পরিচালক মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ঝুঁকি থাকলেও আমরা আশাবাদী। বাচ্চা দুটির মধ্যে তোফা বেশি সক্রিয়, আর তহুরা একটু কম সক্রিয়। আশা করছি অস্ত্রোপচারের পর তারা সুস্থ হয়ে উঠবে।

বিভিন্ন বিভাগের প্রায় ত্রিশজন চিকিৎসক দুটি দলে ভাগ হয়ে দীর্ঘ এই অস্ত্রোপচারে অংশ নেন। অচেতন করাসহ প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষে একদল চিকিৎসক শিশু দুটির দেহ আলাদা করার কাজ শুরু করেন।

দুপুরে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে শিশু সার্জারী বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ আশরাফুল হক কাজল সাংবাদিকদের বলেন, তোফা ও তহুরার স্পাইনাল কর্ড ও মেরুদন্ড আলাদা করতে পেরেছেন তারা। এ পর্যন্ত যতটুকু সম্পন্ন হয়েছে, তা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। শিশু দুটি ভালো আছে।

দুই শিশুকে আলাদা করার পর দুপুরে চিকিৎসকদের অন্য দলটি শুরু করেন দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। এই অস্ত্রোপচারকে কেন্দ্র করে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই অপারেশন থিয়েটারের বাইরে দিনভর অপেক্ষায় ছিলেন সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা।

ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন দুপুরে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের বলেন, কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে এত বড় অপারেশনের কথা ভাবা যেত না।

আপনারা বেশি করে প্রচার করুন। আমাদের চিকিৎসকরা কত বড় অপারেশন করতে পারে, আপনারা দেশবাসীসহ বিশ্ববাসীকে এটা দেখান ও জানান।

সংযুক্ত শরীরের ওই দুই শিশু তোফা ও তহুরা’র বাবা মো. রাজু সাংবাদিকদের জানান, তার বিশ্বাস তাদের দুই শিশু তাদের কাছে ফিরে আসবে। রাজু বলেন, আমিতো গরিব মানুষ। ক্ষেতে কাজ করি। কারো কোনো ক্ষতি করি না। খোদাও আমাগো দেখবে।

অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষায় রয়েছেন তোফা ও তহুরার নানা শহীদুল ইসলাম, ও তাদের পাঁচ বছর বয়সী ভাই শাহাদাত।

শহীদুল ইসলাম সাংবাদিকদের সামনে বলেন, আমার নাতিনদের জন্য দোয়া করবেন। দেশবাসীকে দোয়া করতে বলবেন।

এর আগে সোমবার হাসপাতালের সার্জিক্যাল কনফারেন্স রুমে তোফা ও তহুরাকে কোলে নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন তাদের মা শাহিদা বেগম। তিনিও সংযুক্ত শরীরে জন্ম নেওয়া তার দুই শিশু সন্তান তোফা ও তহুরার দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।