অবেহলায় শমশেরনগর বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ ঝোঁপ জঙ্গলে আবদ্ধ

জয়নাল আবেদীন,মৌলভীবাজার )
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগরের ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভূমিকার জন্য সরকারি অর্থায়নে শমশেরনগর-কুলাউড়া সড়কের বিমান বন্দর এলাকায় বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ ও সম্মুখ সমরের স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়। প্রতি বছরে স্বাাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস এলে এক দিনের জন্য বধ্যভূমি পরিষ্কার করে শুধু পুষ্পার্পণ ছাড়া সারা বছর থাকে অযতœ আর অবহেলায় ঝোঁপঝাড়ে আবদ্ধ এ বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ ও সম্মুখ সমর স্মৃতিস্তম্ভ।
গতকাল (১৪ডিসেম্বর)বৃহস্পতিবার সরেজমিনে শমশেরনগর বধ্যভূমি এলাকায় গিলে দেখা যায়, বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের ফটকে তালা ঝুলে আছে। পুরো স্মৃতিসৌধ এলাকা ঝোঁপঝাড়ে ভরা। সামনে বাঁশ ঝাড়ের আগাছা ফেলে প্রবেশ পথ বন্ধ রাখা আছে। স্মৃতিসৌধের পাকা স্থাপনা দেখে মনেই হয় না গত ২৬ মার্চের পর আর একদিনও পরিষ্কার করা হয়নি। ঝোঁপ ঝাড়ে আচ্ছাদিত থাকায় বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ এলাকায় বিষাক্ত সাপেরও ভয় রয়েছে।
২০০৮ সালের ১৮ আগষ্ট তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমান এ বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেছিলেন। তার পাশেই ২০০১২-২০১৩ অর্থ বছরে মুক্তিযুদ্ধকালীন উল্লেখযোগ্য সম্মুখ সমরের স্থানগুলো সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ১৩ স্থানের সাথে নির্মিত হয়েছে “ শমশেরনগর সম্মুখ সমরের স্মৃতিস্তম্ভ”। বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ ও সম্মুখ সমরের স্মৃতিস্তম্ভ দুটিই নির্মাণ করে গণপূর্ত বিভাগ, মৌলভীবাজার। মৌলভীবাজারের গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে, শমশেরনগর বধ্যভূমি স্মুতিসৌধ নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ৮ লাখ ২৬ হাজার টাকায়। আর সম্মুখ সমরের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ৪৮ লাখ ৩২ হাজার টাকা।
শয্যাশায়ী মুক্তিযুদ্ধের ৪নং সেক্টরের কমলপুর সাব সেক্টরের সাব কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন (অব:) সাজ্জাদুর রহমান বলেন, উপজেলা পরিষদ সমন্বয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শমশেরনগর বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ ও সম্মুখ সমরের স্মৃতিস্তম্ভ দুটিই রক্ষণা বেক্ষণ করবেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। তিনি আরও বলেন, শমশেরনগর বাজার থেকে কিছু দূরে ও নির্জন স্থানে বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ হওয়ায় এখানে দায়িত্বের অবহেলা হচ্ছে। যেহেতু বিমান বাহিনীর নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ এলাকায় এটি সেহেতু একটু উদ্যোগী হলে বিমান বাহিনী কর্তৃপক্ষ এটি রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৮ মার্চ শমশেরনগর থেকেই বৃহত্তর সিলেটের প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, বধ্যভূমি রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে শমশেরনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এব্যাপারে শমশেরনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জুয়েল আহমদ বলেন, বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ সংস্কারের কাজ চলতেছে। আর উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে স্মৃতিসৌধ ও সম্মুখ সমরের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পার্পন করা হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে ঢাকার রেস কোর্স ময়দানে ৭ই মার্চে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষনের পর থেকে প্রতিদিন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগরে মুক্তিপাগল মানুষজন পাকিস্তানী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মিছিল ও সভা করতেন। এ খবরটি স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা আরিফ মুন্সী ও তার অনুসারীদের মাধ্যমে মৌলভীবাজার জেলা সদরে অবস্থানরত পাক সেনা বাহিনীর কর্তাদের কাছে পৌছে যায়। মার্চ মাসের ২০ তারিখের পর থেকে পাক সেনা বাহিনী একটি পিক আপ নিয়ে প্রতি দিন বিকালে শমশেরনগরে টহল দিতে এসে বাঙ্গালীদের ভয় ভীতি প্রদর্শণ করতো। পাক সেনা বাহিনীর টহল দল শমশেরনগরে প্রবেশ করলে নিরস্ত্র বাঙ্গালীরা ভয়ে দৌড়ে পলাতেন। ২৭ মার্চ পাক সেনারা শমশেরনগরের ৮০ বছর বয়সী যাদুকর সিরাজুল ইসলামকে ব্যয়নট চার্জ করে ও পরে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল শমশেরনগর বাজারে। এতে শমশেরনগরের মানুষজন পাক সেনাদের প্রতিরোধে মারমুখী হয়ে উঠেন। পাক সেনা প্রতিরোধে ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ সর্ব প্রথম শমশেরনগরে পরিকল্পিত অভিযান চালিয়ে ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলসহ ৯ পাক সেনাকে হত্যা করেছিল মুক্তি পাগল এলাকাবাসী। তার পর থেকে পাক সেনা বাহিনী স্থানীয় সরকারী ডাক বাংলোয় শক্ত ক্যাম্প স্থাপন করে নিরিহ বাঙ্গালীদের ধরে এনে বট গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন ও নির্যাতন কক্ষে নির্যাতনের পর শমশেরনগর বিমান বন্দরের রানওয়ের উত্তর পশ্চিম কোণের বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করেছে। তাছড়া টানা নয় মাস শমশেরনগরের কয়েকটি স্থানে পাক বাহিনীর সাতে মুক্তিযোদ্ধার সামনা সামনি যুদ্ধ হয়েছিল।