মো. আহছান উল্লাহ,

বরিশালের উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম কুড়োলিয়া। উপজেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত এই গ্রামের নারী পুরুষের সুনিপুণ হাতে তৈরি হয় ১০ প্রকারের মাছ শিকারের বরশি। আর তাদের বরশি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করার ইতিহাস প্রায় শত বছরের।

 

সারা বছর হাতে তৈরি করা মাছ শিকারের বরশির চাহিদা থাকলেও বর্ষা মৌসুমে এর চাহিদা বাড়ে দ্বিগুন। এখানে তৈরি করা বিভিন্ন প্রকার মাছ ধরার বরশি বিক্রি করা হয় দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকারদের কাছে। কাঁচা মালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূলধনের তুলনায় লাভ আগের চেয়ে অনেক কম। এ জন্য সরকারি সহায়তার দাবি করেছেন বরশি তৈরির কারিগররা। বরশি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন পল্লীর প্রায় দুশ পরিবার, যে কারনে এলাকাটি এখন বরশি পল্লী নামেই পরিচিত।

 

বিভিন্ন প্রতিকুলতা ছাপিয়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকা এ পল্লীর মানুষের গল্প অপরাজিত। সবুজ প্রকৃতির সুরেলা সহাবস্থানকে মেনে চলা সাজানো গোছানো এই পল্লীতে বরশি তৈরীর টুং টাং শব্দে যে কোনো মানুষের হৃদয়কে প্রশান্তিতে ভরে দেয়। পল্লীর শান্ত পরিবেশ আর সহজ সরল মানুষগুলোর বিনয়ী আচরন মনে করিয়ে দেয়, গ্রামই আমাদের দেশের প্রান।

বরশি পল্লীতে গেলে দেখা যায়, ঘরে ঘরে বিভিন্ন প্রকারের বরশি তৈরির কাজ চলছে। পরিবারের সবাই এ কাজে এক অপরের সহযোগি হিসেবে কাজ করছেন। কেউ আগুনে লোহা পুরে তা পিটিয়ে সলাকা তৈরি করছেন আবার কেউ সেই সলাকা ছোট ছোট টুকরো করে দিচ্ছেন। আরেকজন বাকা করে সেই সলাকা বরশিতে রুপ দিচ্ছেন। ঘরের বারান্দা ও বাড়ির আঙিনায় বসে নারী-পুরুষরা মিলে মিশে তাদের সুনিপুণ হাতে বরশি তৈরির কাজ করছেন।

বরশি পল্লীর বাসিন্দা ও বরশি তৈরির কারিগর সচিন মন্ডল (৪৫) বলেন, এক সময় বরশি তেরি করে ভালোভাবে চলা যেত এখন এ কাজে টিকে থাকতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। বরশি তৈরির কাঁচামাল লোহার দাম বেড়ে গেছে, তাছাড়া চায়না জালসহ কিভিন্ন মাছ ধরার পন্য সহজলভ্য হওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পরছে আমাদের উপর।

বরশি পল্লীর বাসিন্দা ও বরশি তৈরির কারিগর বাসুদেব বাড়ৈ (৬৫)  বলেন, অজপাড়াগা এবং বিল অঞ্চল হওয়ায় আমাদের ছোট বেলা থেকেই অনেক কষ্ট করে বাঁচতে হচ্ছে। আমরা বংশ^পরম্পরায় এ কাজ করে আসছি। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বরশি তৈরি করেই জীবন চলছে। প্রথমে পুঠি মাছের বরশি তৈরি করতাম এখন হাজারী, কইয়া, বোয়ালীসহ ১০ প্রকারের বরশি তৈরি করি।

পল্লীর বাসিন্দা ও বরশি তৈরির কারিগর আদিত্য বাড়ৈ (৭০)  বলেন, প্রথমে লোহা আগুনে জ¦ালিয়ে সলাকা তৈরি ও সাইজ করে কাটা হয়। এরপর ঘষে পিটিয়ে বিভিন্ন বরশি তৈরি করা হয়। বরশি তৈরি হলে আবার আগুনের তাপ দিয়ে বরশির ট্যাম্পার (শক্ত) করা হয়। প্রতি হাজার বরশি সাইজ অনুপাতে আমরা দুই থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করি। প্রতি হাজার বরশিতে আমাদের ৫শ থেকে ৭শ টাকা আয় হয়।

তিনি আরো বলেন, আমাদের তৈরি বরশি দেশের প্রায় সব জেলাতে যায়। এক সময় আমরা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বরশি বিক্রি করতাম এখন পাইকাররা এসে বরশি নিয়ে যায়। স্থানীয় বাজারে পইকার ও খুচরা ব্যবসায়িদের কাছে আমরা নিজেরা গিয়ে বরশি দিয়ে আসি। আবার বিভিন্ন ব্যবসায়িদের কাজ থেকে অর্ডার নিয়ে তাদের চাহিদা অনুযায়ী বরশি তৈরি করে দেয়া হয়।

মঙ্গল বাড়ৈর বাড়ির আঙিনায় গিয়ে দেখা গেল, তিনিসহ দুই তিনজন পুরুষে লোহার সলাকা ঘষে সুচারু করছেন। পাশে উষা রানী, বাসন্তী রানীসহ অনেকেই বরশি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কাজের ফাঁকে মঙ্গল বাড়ৈ বলেন, ‘আমি ৪০ বছর ধরে এ পণ্য তৈরির কাজ করছি। কইয়া পুঠি হাজারী বোয়ালীসহসহ ১০ প্রকারের বরশি তৈরি করতে পারি। যখন যে ধরনের অর্ডার থাকে, তখন সে ধরনের বরশি তৈরি করি।

বরশি তৈরির কারিগর সবিতা রানী বলেন, আমি বরশি তৈরির সব কাজ পারি না। তবে যে টুকু পারি সে টুকু দিয়ে স্বামীকে সহযোগিতা করছি। এ বাড়ির অপর গৃহবধু অঞ্জনা মন্ডল বলেন, বরশি তৈরিতে মজুরি একটু কম হলেও কাজটি বাড়িতে বসে অবসর সময়ে করা যায়। এ আয় আমাদের সংসারে কিছুটা হলেও বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আবদুর রশিদ সরদার (৭৫) বলেন, এই পল্লীর বাসিন্দারা একসময় বিলের সাপলা তুলে বিক্রি ও দিনমজুরের কাজ করে জীবিকানির্বাহ করতেন। তবে বরশি তৈরির শিল্প তাদের নতুন করে বাঁচতে আশা জাগিয়েছে। বিশে^র বিভিন্ন দেশে আধুনিক প্রজুক্তি ও যান্ত্রিকভাবে বরশি তৈরি করা হয়। অথচ আমাদের বরশি পল্লীর বাসিন্দারা তাদের সুনিপুন হাতে অনেক কষ্ট কওে বরশি তৈরি কওে এ পেশায় টিকে আছেন।।

স্থানীয় বাসিন্ধা ও শিক্ষিকা রিনা রানী জযধর  বলেন, এ পল্লীর বাসিন্ধারা বংশপরম্পরায় বরশি তৈরি করে আসছেন। অনুমান করা হচ্ছে শত বছর আগে থেকেই বরশি তৈরি হতো এ পল্লীতে। বর্তমানে বরশির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কাজের চাহিদাও বেড়েছে। আমরা এটিকে একটি সম্ভাবনময় খাত হিসেবে দেখছি। তবে এ খাতে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।

উজিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারিহা তানজিন  বলেন, জল্লা ইউনিয়নের কুড়োলিয়া গ্রামের বরশি পল্লীর বরশি তৈরির কারিগরা সরকারের কাছে তাদের যে কোন সমস্যার কথা জানালে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করা হবে।