শটির পালোয় আলো দেখছে মিনতি রানীরা

মো.আহছান উল্লাহ ও বিডি কামাল সাকোকাঠী থেকে ফিরে।
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম দক্ষিন সাকোকাঠী। এই গ্রামের জেলে পল্লীর নারীরা তৈরি করছেন শটির পালো। শিশু থেকে বয়বৃদ্ধদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারি একটি প্রাকৃতিক খাবার পালো। মানব দেহের বিভিন্ন জটিল রোগ সারাতে,প্রাচীন কাল থেকে লোকজ চিগিৎসায় শটির পালোর ব্যবহার ছিল গুরত্বপূর্ন। পালো একটি পুষ্টিকর বিকল্প প্রাকৃতিক খাবার। সময়ের বিবর্তনে জনস্বাস্থ্যের জন্য উপকারি পালো এখন বিলুপ্ত প্রায়। বিভিন্ন প্রতিকুলতার মাঝে পালো শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন জেলে পল্লীর নারীরা। বছরে প্রায় সাতশ কেজী পালো উৎপাদন করছেন তারা দিনদিন চাহিদাও বাড়ছে। পালো নিয়ে তাদের সপ্ন অনেক। সরকারি,বে-সরকারিভাবে পৃষ্টপোষকতার দাবী জানিয়েছেন পালো শিল্পীরা।
এ মহতি উদ্যোগের নেপথ্য কারিগর হলেন জেলে পল্লীর বাসিন্ধা মিনতি রানি দাস (৮০)। তিনিই প্রথম পালো তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেন। তার হাত ধরেই এক এক করে পল্লীর ৫৮ জন নারী বাড়িতে বসে,সংসারের কাজের ফাকে শঠির পালো তৈরি করছেন। পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ ঘরে বসে বাড়তি আয় করে অভাবের সংসারে একটু আর্থিক যোগানও দিচ্ছেন। কোন পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই জেলে পল্লীর নারীদের বারতি আয়ের আনন্দ বলে দেয়, বাংলাদেশের পরিত্যাক্ত লাতাপাতা আর আবর্জনা হতে পারে দেশের সোনা।
শটি প্রাচীনকাল থেকে মানব স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যবহৃত একটি ভেষজ উদ্ভিদ। এ গাছের কন্দ থেকে তৈরি হয় পালো। দেশে এলাকাভেদে শটি,হডি,সাদা হলুদ,বনফুলসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম কারকুমা জেডোরিয়া। মুল্যবান এই ভেষজটি সমতল জমির পাশে কিংবা রাস্তার পাশে কোন পরিচর্জা ছাড়াই জন্মে থাকে। এর কন্দ সংগ্রহ করে পালো তৈরি করা হয়।
পল্লীর কনক রানী দাস (৫৫),অঞ্জলী রানী দাস (৬০),জয়ন্তী রানী দাস (৩৫) বলেন, অগ্রহায়ন,পৌষ মাসে বিভিন্নভাবে শটির কন্দ সংগ্রহ করা হয়। এরপর ভালোভাবে ধুয়ে পরিস্কার করে ছোট টিনের টুকরা চিদ্র করে তার উপরে ঘষে কন্দগুলোকে কুঁচি কুঁচি করে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয় ১২ ঘন্টা। এরপর ধুয়ে উপর থেকে পানিসহ ময়লা ফেলে দিলে নিচে ময়দার মত পালো জমা হয় এটি একইভাবে ৫/৬ বার ধুয়ে সুখিয়ে নিতে হয়। ১৫ থেকে ২০ কেজী কাাঁচা শটির কন্দে এক কেজী খাওয়ার উপযোগী পালো তৈরি হয়। সম্পূর্ন হাতে তৈরী এই পালো স্বাভাবিক আবহাওয়ায় ২ বছরে নষ্ট হয় না। তাদের উৎপাদিত পালো প্রতি কেজী ৬শ টাকায় বিক্রি হয়।
পালোয় আলো দেখানোর নেপথ্যের কারিগর মিনতি রানী দাস (৮০) বলেন,ছোট বেলায় মার কাজ থেকে পালো বানানো শিখেছি। পালো সব বয়সের মানুষের জন্য একটি ভালো খাবার। আমাদের পরিবারের পুরুষরা সন্ধা ও আড়িয়াল খা নদীতে মাছ শিকার করে কোনমতে জীবিকা নির্বাহ করে। আমাদের কোন কৃষি জমি না থাকায় পল্লীর ঝি,বউদের পালো বানানো শিখিয়েছি। এখন ওরা নিজেদের চাহিদা মিটিয়েও বাজারে বিক্রি করে বাড়তি কিছু টাকা আয় করছে এতে ওদের পরিবারের অনেক উপকার হচ্ছে।
পল্লীর বাসিন্দা এবং পালো সরবরাহকারী নিতাই দাস (৬০) বলেন, আমাদের জেলে পল্লী এখন পালো পল্লী নামেও অনেকে চিনে। আমরা প্রতি কেজী পালো ৬শ টাকা পাইকারী বিক্রি করি। বাজারে প্রচুর চাহিদা আছে পালোর কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী আমরা সরবরাহ করতে পারছিনা। পালো তৈরি করতে শটির প্রয়োজন শটি কম হওয়ায় পালোও কম হচ্ছে। বারোমাস যাতে পালো তৈরি করা যায় সে চেষ্টাও আমরা চালাচ্ছি। বর্তমানে আমাদের এ পল্লীর প্রতি ঘরেই পালো তৈরী হয় বছরে তিন মাস। সব মিলিয়ে ৫ থেকে ৭শ কেজী পালো তৈরি করা হয়। পল্লীর সব বাসিন্ধারাই এখন কমবেশী পালো তৈরি করছেন। বাজারে এর অনেক চাহিদা রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্ধা কার্তিক চন্দ্র মন্ডল (৬৫) বলেন, এটি একটি শিল্প, পল্লীর নারীরা অনেক কষ্ট করে এ লোকজ শিল্পটাকে টিকিয়ে রেখেছেন। অভাবী অসহায় এই উদ্যোগী নারীদের সরকরি বে-সরকারি পৃষ্টপোষকতা দেয়ার জন্য জোড় দাবী জানাই।
কুয়েত প্রবাসি পুষ্টিবীদ ইলিয়াস বীন শওকত বলেন, শটির পালোর উপকারিতাগুলি স্বাস্থ্যের জগতে আলোচিত আকর্ষণীয়। আমেরিকা ও ইউরোপে শটির বানিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে। শটির পালোয় স্বাস্থ্যের উপকারিতা অসাধারণ, তবে খুব কম মানুষই জানেন। শটির পালোর অন্যতম স্বাস্থ্য উপকারিতা হল ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে লড়াই করা। জয়েন্টগুলোতে প্রদাহ ও ব্যথা দূর করে শরীর থেকে টক্সিন অপসারণ করে, ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন চর্মরোগের জন্য একটি কার্যকর প্রাকৃতিক প্রতিকার। এটি অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি-ফাঙ্গাল হিসাবে কাজ করে। পালো সেবনে পাকস্থলীর স্বাস্থ্য ও হজমশক্তি ঠিক রাখে। এ ছাড়াও ডায়রিয়া, ফুড পয়জনিং এবং অন্যান্য কারণে হজমের সমস্যাগুলি নিরাময় করে। আলসার প্রতিরোধ করতে পারে। শিশুদের জন্যও এটি একটি আদর্শ খাবার। বর্তমানে উন্নত অনেকে দেশে পালো মেয়েদের রুপচর্জাও ব্যবহার হয়।
গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাইয়েদ মুহাম্মাদ আমরুল্লাহ বলেন , শটির পালো একটি ভালো প্রাকৃতিক খাবার। মানবদেহের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে এর ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। তবে এটি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করতে হবে।