অ্যান্টার্কটিকায় সুবিশাল গর্ত

(( মিতু গাইন )) আমাদের পশ্চিমবঙ্গের আয়তন যতটা, প্রায় ততটা জায়গা জুড়েই সুবিশাল একটা গর্তের হদিশ মিলল অ্যান্টার্কটিকায়। এর আগে এত বড় গর্তের হদিশ আর মেলেনি সেখানে।
দক্ষিণ মেরুর পুরু বরফের চাদরের তলায় প্রায় ৪০ বছর লুকিয়ে থাকার পর আবার উপগ্রহের ক্যামেরায় ধরা দিয়েছে সেই সুবিশাল গর্ত। যার মধ্যে অনায়াসেই ঢুকে যেতে পারে গোটা পশ্চিমবঙ্গ! ৩০ হাজার বর্গ মাইলেরও বেশি এলাকা জুড়ে থাকা সেই গর্তের গভীরতা কতটা, সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তবে সেই গর্তটির হদিশ মিলেছে যে জায়গায়, সেই জায়গাতেই রয়েছে অ্যান্টার্কটিকার গভীর ওয়েডেল সমুদ্র। তাই গর্তটির গভীরতা খুব কম নয় বলে়ই ধারণা বিজ্ঞানীদের।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সেই গর্তের গভীরে বয়ে চলেছে তরল জলের উত্তাল সমুদ্র। যার নীচের জল দক্ষিণ মেরুর হাড়জমানো ঠাণ্ডাতেও সমুদ্রপৃষ্ঠের জলের চেয়ে অনেক বেশি গরম। যেন ফুটছে! আর সাধারণ সমুদ্রের জল যতটা নোনতা হয়, সুবিশাল সেই গর্তের ভিতরের জল তার চেয়ে অনেক বেশি লবণাক্ত।
অ্যান্টার্কটিকার পুরু বরফের চাদর ফাটিয়ে প্রায় একই আকারের একটি গর্ত প্রথম মুখ দেখিয়েছিল ১৯৭৭ সালে। তার পর কোথায় যেন হারিয়েই গিয়েছিল অ্যান্টার্কটিকার সেই গর্তটি। গত মাসে প্রায় একই জায়গায় সেই গর্তের হদিশ মিলেছে বলে জানিয়েছেন টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয় ও সাদার্ন ওশন কার্বন অ্যান্ড ক্লাইমেট অবজারভেশন অ্যান্ড মডেলিং (এসওসিসিওএম বা ‘সোকম’)-এর বিজ্ঞানী, গবেষকরা। আকারে এর চেয়ে অনেক ছোট হলেও প্রায় একই রকমের আরেকটি গর্তের হদিশ মিলেছিল গত বছর। অ্যান্টার্কটিকায়। ওয়েডেল সমুদ্রেই। তার পর থেকেই বিভিন্ন উপগ্রহের মাধ্যমে অ্যান্টার্কটিকার ওই পুরু বরফের চাদরের ওপর নজর রেখে আসছিলেন বিজ্ঞানীরা।
টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক কেন্ট মুর বলেছেন, ‘‘অ্যান্টার্কটিকার পুরু বরফের চাদরের তলায় লুকোনো এই গর্তের নাম ‘পলিনিয়া’। এখনও পর্যন্ত যতগুলি পলিনিয়ার সন্ধান মিলেছে, এটি তার মধ্যে বৃহত্তম। যেটা আমাদের চমকে দিয়েছে, তা হল ৪০ বছর আগে অ্যান্টার্কটিকার পুরু বরফের চাদরের তলায় এমন একটা গর্ত দেখা দিয়ে আবার হারিয়েও গিয়েছিল। ৪ দশক পর আবার বরফের চাদর ফাটিয়ে সেটা মুখ দেখিয়েছে।’’
সমুদ্রের জলের স্রোত গর্তের ভিতরের অনেক বেশি গরম জলকে ঠেলে সমুদ্রপৃষ্ঠে তুলে দেয়। যে ভাবে কেটলিতে জল ফুটলে তা ওপরের দিকে উঠে আসে। গরম জল ঠেলেঠুলে সমুদ্রপৃষ্ঠে উঠে আসায় সেই ফুটন্ত জলের তাপে ওপরে জমে থাকা অ্যান্টর্কটিকার পুরু বরফের চাদর গলিয়ে দিতে শুরু করে। ফলে, সেই বরফের চাদরে ফুটো হয়। আর ফুটো হতেই বেরিয়ে পড়ে তার তলায় লুকিয়ে থাকা সুবিশাল গর্তের ‘জ্বালামুখ’। এটাকেই বলে ‘পলিনিয়া’।
অ্যান্টার্কটিকায় হাড়জমানো ঠাণ্ডার জন্য পলিনিয়া প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। তাই বহু বহু দশক পর ছোট একটা পলিনিয়া দেখা গিয়েছিল অ্যান্টার্কটিকার ওয়েডেল সমুদ্রে, গত বছর। আর তার আগে বিশাল একটা পলিনিয়া মুখ দেখিয়েছিল সাতের দশকে।
পলিনিয়া তৈরি হলে সেই গর্তের ওপরে উঠে আসা অত্যন্ত গরম জলটা যেহেতু সব সময় থাকে সমুদ্রপৃষ্ঠের ওপরের বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে, তাই খুব অল্প সময়ে সেখানে আবার বরফটা জমে উঠতে পারে না। বরফের চাদরটা ঠিকমতো তৈরি হয়ে উঠতে পারে না। তা পুরুও হয়ে উঠতে পারে না। তাই এক বার পলিনিয়া দেখা দিলে তা দীর্ঘ দিন ধরে দেখতে পাওয়ার কথা। তা চট করে হারিয়ে যেতে পারে না।
যখন গরম জলটা অ্যান্টার্কটিকার হাড়জমানো ঠাণ্ডায় ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে জমতে শুরু করে। আর তা হলেই যেহেতু সেটা খুব ভারী হয়ে যায়, তাই সেটা ঝুপ করে গর্তের গভীরে ঢুকে যায়। যেখানকার জল প্রায় ফুটছে। সেই গরমে আবার গরম হয়ে উঠলে তা ফের উঠে আসে সমুদ্রপৃষ্ঠে। এই ভাবেই পলিনিয়া জন্মায় আর হারিয়ে যায়।
নিশ্চিত নন বিজ্ঞানীরা। অধ্যাপক মুর বলছেন, ‘‘আমরা বুঝতে পারছি না, গত বছরের পর ওই একই এলাকায় এ বার আরও অনেক বড় চেহারার ওই গর্তের হদিশ মিলল কী ভাবে! ৪০ বছর পর কেন অত বড় চেহারার পলিনিয়া ওয়েডেল সমুদ্রের একই জায়গায় দেখা গেল, সে ব্যাপারেও কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই আমাদের এখনও পর্যন্ত। হতে পারে তা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য। যদিও এ ব্যাপারে আমাদের সংশয় কাটেনি এখনও।’’
বিজ্ঞানীদের এমনও ধারণা, ওয়েডেল সমুদ্রের তলায় যে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা রয়েছে, হতে পারে শ্বাসের বাতাস পাওয়ার জন্য তাদের কোনও শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া ঘটেছে, যার পরিণতিতে জন্ম হয়েছে এই পলিনিয়ার।
অধ্যাপক মুরের কথায়, ‘‘আগামী দিনে অ্যান্টার্কটিকার জলবায়ু পরিবর্তনে এই পলিনিয়া কোনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে কি না, তা নিয়েও সংশয় কাটেনি আমাদের।’’