জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে টানা দুর্যোগের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ

এস এম রহামান হান্নান,
স্টাফ রিপোর্টার চলতি বছর বদলে গেছে বাংলাদেশে আবহাওয়া। বর্ষা শুরুর আগেই এ বছর বৃষ্টি শুরু হয়। একই সঙ্গে শরতেও বৃষ্টি দেখা পাচ্ছে প্রকৃতি। সঙ্গে অসহ্য গরম। গত মৌসুমে শীতের কনকনে আবহাওয়া ছিল না বেশি দিন। জলবায়ু পরিবতনের কারণে সারাবিশ্বেরই আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটেছে। তার রেশ পড়েছে বাংলাদেশও। গত বছর শীতে ঠাণ্ডা কম অনুভূত হলেও চলতি বছর শীতের অনুভূতি আগের চেয়ে বেশি হবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বদলে যাওয়া আবহাওয়ায় বাংলাদেশে এবার ঋতুর পরিবর্তন হয়েছে নানা দুর্যোগের মধ্যেই। এই অবস্থায় আজ আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস পালন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দুর্যোগের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে সারাবিশ্বে প্রতিবছর ১৩ অক্টোবর দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে।
চলতি বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়- ‘দুর্যোগ সহনীয় আবাস গড়ি, নিরাপদে বাস করি।’ আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস উপলক্ষে ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ড বিষয়ক মহড়া শুরু হয়েছে। গত বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন শপিং মল ও মার্কেটে এই মহড়ার উদ্বোধন করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া।
পাশাপাশি দিবসটি উপলক্ষে সভা, সেমিনার ও টিভি চ্যানেলগুলোতে বিভিন্ন টকশোর আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় দৈনিকে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ, লিফলেট বিতরণ, সড়ক দ্বীপ সাজসজ্জা, র‌্যালি, সরণিকা প্রকাশ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছে। বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, দুর্যোগঝুঁকি মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবক ও স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণমূলক সংস্কৃতি সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ‘রোল মডেল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, বর্তমান সরকার দুর্যোগ ঝুঁকি কমাতে কার্যক্রমে কাঠামোগত ও অবকাঠামোগত বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। তিনি বলেন, জনগণ যাতে বিনামূল্যে আবহাওয়ার বার্তা পায় সে জন্য আমরা যে কোনো মোবাইল থেকে ১০৯০ নম্বরে (টোল ফ্রি) ফোন করে আবহাওয়া বার্তা পাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। ভূমিকম্প মোকাবিলায় এরই মধ্যে ১৬৯ কোটি টাকার উদ্ধার সামগ্রী কেনা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবারের হাওর অঞ্চলের ৬টি জেলায় আকস্মিক ও নজিরবিহীন বন্যা, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও চট্টগ্রামের পাহাড়ধস, উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় মোরা ও উত্তর অঞ্চলসহ দেশের ৩৫টি জেলায় দুই দফায় ব্যাপক বন্যা সরকার সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে।
এদিকে ভৌগোলিক কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অবস্থান বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন। তাই দেশ ভেদে প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও ভিন্নতা রয়েছে। চলতি মাসে ও নভেম্বর মাসে বঙ্গোপসাগরে একাধিক নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে চলতি অক্টোবর মাসে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে ২টি নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে। যার মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ার আশঙ্কা আছে। একই শঙ্কা রয়েছে পরবর্তী নভেম্বর মাসেও। নভেম্বরেও সাগরে দুটি নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে, যার কমপক্ষে একটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার শঙ্কা করেছে। যা গত কয়েক বছরের আবহাওয়ার সঙ্গে মিলছে না। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, আবহাওয়া-জলবায়ুর তথা-উপাত্ত, ঊর্ধ্বাকাশের আবহাওয়ার বিন্যাস, বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরের বিশ্লেষিত আবহাওয়া মানচিত্র, জলবায়ু মডেল, এল-নিনো এবং লা-নিনা অবস্থা ইত্যাদি উপাদান আলোচনা-পর্যালোচনা করে এই পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে।
এদিকে আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। মাসজুড়েই দেশের বিভিন্ন এলাকাভেদে বৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যাপক অসঙ্গতি ও বৈপরীত্য ছিল। যেমনÑ সেপ্টেম্বরে দেশের বিভাগওয়ারি হিসেবে চট্টগ্রামে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭১ দশমিক ২ শতাংশ বেশিই বৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে ২ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি, ময়মনসিংহে ৪৮ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি, সিলেটে ২৪ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদফতর জানায়। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলে এমনকি দক্ষিণাঞ্চলেও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম বৃষ্টি হয়েছে। গত মাসে রাজশাহী বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ কম, রংপুর বিভাগে ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ কম, খুলনা বিভাগে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ কম এবং বরিশালে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ কম পরিমাণে বৃষ্টি হয়েছে।
প্রকৃতির চরমভাবাপন্ন ও বৈরী আচরণের কারণে একের পর এক দুর্যোগের ঘনঘটায় চরম জনদুর্ভোগ তৈরি হয়েছে চলতি বছর। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, চীন পর্যন্ত অস্বাভাবিক বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়েছে। দেশে বৈরী আবহাওয়ার প্রভাব শুরু গত মার্চ মাসে। প্রথমে বন্যা, এরপর ভূমিধস-পাহাড়ধস, এরপর ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী ও বজ পাতের আধিক্য, দেশজুড়ে দাবদাহ, অতিবৃষ্টি বিরূপ প্রভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে চলতি বছরের শুরুতে শীতের প্রভাব ছিল ঠিক উল্টো। শীত ছিল প্রকোপহীন ও সংক্ষিপ্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আবহাওয়ার ‘এল-নিনো’ অবস্থা (বৃষ্টি রোধকারী) কমে গিয়ে লা নিনোর প্রভাবে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, চীনে বর্ষারোহী মৌসুমি বায়ু সক্রিয় ও জোরদার ছিল। বাংলাদেশ ও ভারতে এবার মৌসুমি বায়ুর আগমনও ঘটে বেশ আগেভাগেই। সব মিলিয়েই চলতি বছর বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অনেক দুর্যোগ গেছে। আগামী তিন মাসও এই ধরনের বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করবে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাই দুর্যোগ মোকাবিলায় আগে থেকে বাংলাদেশকে তৈরি হতে হবে। তৈরি হতে হবে দুর্যোগের আগে, দুর্যোগের সময়ে এবং দুর্যোগের পরের সময়গুলো যথাযথভাবে মোকাবিলা করার।