হযরত কায়েদ ছাহেব হুজুর (রহ.) এক বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী ক্ষনজন্মা ব্যক্তিত্ব (চতুর্থ পর্ব)

((মুহম্মাদ আহছান উল্লাহ)) = পূর্ব প্রকাশের পর t হযরত কায়েদ ছাহেব হুজুর (রহ.) ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী এক ক্ষনজন্মা ব্যক্তিত্ব। তারঁ গোটা জীবন-ই আমাদের জন্য ইসলামী জেন্দেগী গঠনের এক অনন্য পাথেয়। হুজুর কেবলা (রহ.) যেমন ছিলেন একজন কামেল মুর্শিদ, ওলী, দরবেশ, সূফী সাধক ও আধ্যাত্মিক নেতা, তেমন ছিলেন একজন ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক, গবেষক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসাবিদ, লেখক ও সংগঠক।প্রজ্ঞায়, পান্ডিত্বে. আধ্যাত্মিকতায়, আদর্শবাদিতায়, সততায়, নিষ্ঠায়, উদারতায়, আমলে, আখলাকে তারঁ মত একজন মহত মানুষ সত্যিই বিরল। তারঁ জীবন ও কর্মই তাঁর বাস্তব প্রমান।পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে কিছু ক্ষণজন্মা মানুষের আবির্ভাব ঘটে। নিঃসন্দেহে মরহুম মাওলানা আযীযুর রহমান নেছারাবাদী তাদের মধ্যে অন্যতম। একজন মানুষের এত বহুমুখী প্রতিভার সমনয় ঘটতে আমরা সচরাচর দেখি না। তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ মানুষ বা ইনসানে কামিল।
ইসলামী আদর্শের সত্যিকার প্রতিচ্ছবি ছিলেন তিনি। তাঁকে দেখলে নজরুলের কবিতার সেই পঙক্তির কথা মনে পড়ে ইসলাম সে তো পরশমানিক কে তারে পেয়েছে খুঁজি, পরশে তাহার সোনা হলো যারা তাদেরই মোরা বুঝি।’ তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যার মধ্যে ইসলামের মহত্বের পরিচয় পাওয়া যেত, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশালতা প্রতিভাত হত।
জীবনের প্রতিটি স্তরে ছিল তাঁর সফল বিচরণ, প্রত্যেক স্তরে রেখে গেছেন তাঁর নিজস¦তা। আর এ নিজস¦তাই করেছে তাঁকে অন্য সকলের চেয়ে ; মানবকল্যাণের যে মহান ব্রত নিয়ে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে সে মানবকল্যাণই ছিল তাঁর প্রত্যেক কর্মের গন্তব্য। আর এ কারণেই ধর্ম-বর্ণ নির্বেশেষে সব মানুষের জন্য তাঁর দ্বার ছিল উন্মুক্ত এবং সব শ্রেণীর মানুষও হয়েছে তাঁর ভক্ত ও অনুরক্ত। মানবীয় গুণাবলীর সমন¦য় ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। তিনি ছিলেন উদার, সদালাপী, পরমত সহিষ্ণু, নিরহংকার, বিনয়ী, জ্ঞানী, পরোপকারী, অতিথিপরায়ণ, অধ্যাবসায়ী, দানশীল, ক্ষমাশীল ও আত্মপ্রত্যয়ী। তিনি ছিলেন সত্যিকারের মুমিন।
কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত পথেই তিনি তাঁর জীবন পরিচালিত করেছেন। পার্থিব ও আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব সমন¦য় ঘটেছিল তাঁর জীবনে।
শিক্ষা জীবন ঃ
হুজুর নিজ গ্রামে বসেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। নিজ গ্রামের পাঠশালায় বাংলা শিক্ষার পাশাপাশি তিনি চাঁদকাঠী নিবাসী মুন্সী সিরাজ উদ্দিন ছাহেব ও ঝালকাঠী কেন্দ্রীয় মসজিদের তৎকালীন ইমাম জনাব মরহুম মৌলভী মুহসিন উদ্দিন ফরিদপুরী ছাহেবের কাছে আরবী শিক্ষা লাভ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পরে হুজুর কেবলার মনে মাদরাসায় পড়ার এক অদম্য আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

মাদরাসা শিক্ষার প্রতি হুজুর কেবলার অদম্য আগ্রহ দেখে তাঁর মহিয়সী মাতা হুজুর কেবলাকে মাদরাসায় পড়াবার সিদ্বান্ত নিলেন। তখন এই এলাকার কিছু ছাত্র ভোলা আলিয়া মাদসায় পড়াশুনা করতো। হুজুরকে তাঁর মাতা তাঁদের সাথে ১৯৩০ ইং সনে ভোলা আলিয়া মাদরাসায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে গিয়ে হুজুর জামাতে দাহমে ভর্তি হন। ভোলা মাদরাসায় অধ্যয়ন কালে হুজুর কেবলার প্রখর মেধা ও প্রতিভা দেখে মাদরাসার শিক্ষক ও ছাত্ররা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন। হুজুর কেবলার কন্ঠ ছিল খুবই মধুর। তিনি মধুর কন্ঠে যখন কেরাত ও গজল পাঠকরতেন তখন সবাই মোহিত হয়ে যেত। ভোলার বড় বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হুজুর কেবলাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। হুজুর সেখানে সুমধুর কন্ঠে কেরাত ও গজল পাঠ করতেন।
ভোলা আলিয়া মাদরাসায় অধ্যয়ন কালে প্রত্যেক পরীক্ষাই প্রথম স্থান অধিকার করতেন এবং মাদরাসার সম্মিলিত মেধা তালিকায়ও প্রথম হতেন। হুজুর খুব কষ্ট করে পড়া শুনা করতেন। কারন, তখন হুজুরের সংসার ছিল খুবই অভাবের। বিধবা মা হুজুরের পড়া লেখার খরচ জোগাতে সক্ষম ছিলেন না। ছাত্র জীবনের কষ্টের কথা হুজুর তাঁর এক আলোচনায় এভাবে তুলে ধরে ছিলেন, “আমি তখন ভোলা মাদরাসায় পড়ি। বিশেষ প্রয়োজনে কিছু টাকা চেয়ে মায়ের কাছে পত্র লিখেছিলম। আমার মা বহুজনের কাছে কিছু টাকা ধার চেয়েও পেলোনা। নিরাশ হয়ে তিনি তাঁর ব্যবহার্য গলার জিনিস বন্দক রেখে সুদে কিছু টাকা পাঠালেন। আমি এ খবর শুনে মার কাছে টাকাগুলো ফেরৎ পাঠিয়ে দিলাম এবং মাকে চিঠি লিখে জানালাম : এভাবে আমার জন্য কখনও টাকা পাঠাবেননা। আমি আল্লাহর রহমাতে ফরজ আন্দাজ ইলমে দ্বীন শিক্ষা করেছি। এখন যা শিখব তা নফল। সুদের টাকায় ইলমেদ্বীন অর্জন করাকে জায়িয মনেকরি না”।

১৯৩৬ ইং সনে হুজুর ছারছীনা আলীয়া মাদরাসায় জামাতে পাঞ্জমে হাদীসে ভর্তি হন। আল্লাহর রহমত যার সঙ্গী তাঁর জীবন চলার পথ যত কন্টকাকীর্ণই হোক না কেন সে পথ সহজ থেকে সহজতর হয়েযেতে বাধ্য। হুজুর কিবলার ছাত্র জীবনের ঘটনাবলী তার সুস্পষ্ট প্রমান। ছারছীনা আলীয়া মাদরাসায় হুজুর ফাজিল পর্যন্ত পড়া শুনা করেছেন। ১৯৪০ ইং সনে ফাজিল কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় হুজুর কলকাতা মাদরাসা বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান অধিকার করে বৃত্তি পান।

তখন ভারত উপমহাদেশে কলকাতা আলীয়া মাদরাসা ব্যতীত অন্য কোথাও টাইটেল (কামিল) পড়ার ব্যবস্থা ছিলনা। তাই হুজুর নির”পায় হয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ ধর্মীয় বিদ্যাপীঠ ঐতিহাসিক কলকাতা আলীয়া মাদরাসায় ১৯৪১ ইং সনে কামিল জামাতে ভর্তি হন। ১৯৪১ থেকে ১৯৪২ ইং পর্যন্ত কলকাতা আলীয়া মাদরাসায় অধ্যয়ন কালে ভারত বর্ষের শ্রেষ্ঠ আলিমদের সাহচর্য ও ছোহবাত নিয়ে উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা সমাপ্ত করেন। হুজুর কেবলা তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ্, ঊসূলে ফিকাহ্, বালাগাত, মানতিক ও তাসাউফ শাস্ত্রে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। পাশাপাশি তিনি বাংলা, ইংরেজী ও ফার্সী ভাষা সাহিত্যেও অগাত পান্ডিত্যের অধিকারীহন। কলকাতা মাদরাসায় অধ্যায়ণ কালে হুজুর “আনজুমানে আল ইসলাহ” নামে একটি ছাত্র সংগঠন কায়েম করেণ।

ইলমে তাছাঊফ অর্জন ঃ
ইলমে তাছাওফ শিক্ষা করে সে অনুযায়ী আমলী জেন্দেগী গঠণ করার জন্য হযরত কায়েদ ছাহেব হুজুর (রহ.) ছারছীনা শরীফের পীরে কামেল, মুজাদ্দেদে যামান আলহাজ্ব হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী নেছার উদ্দিন (রহ.) এর কাছে বয়াত গ্রহণ করেন। কলকাতা আলীয়া মাদরাসায় লেখা পড়া শেষে তিনি পুনরায় চলে আসেন ছারছীনায়। ছারছীনায় এসেই হুজুর পীর ছাহেবের হাতে বয়াত গ্রহণ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই হুজুর চার তরীকায় কামালিয়াত অর্জণ করেন। ছারছীনার পীর নেছার উদ্দিন (রহ.) এর খলীফাগনের মধ্যে হুজুর অন্যতম খলীফা ছিলেন। কিন্তু তিনি কাউকে মুরীদ করতেন না। অথচ বহু মানুষ তাঁর কাছে মুরীদ হওয়ার জন্য খুব আগ্রহ পোষণ করতেন। শেষ জীবনে বিশেষ কারনে মুরীদ করেছেন। হুজুর পূর্বে কেন মুরীদ করতেনা এবং শেষ জীবনে কেন করেছেন এ সর্ম্পকে হুজুর বিগত ১৯/০৩/২০০২ ইং তারিখ নেছারাবাদের বর্ষিক মাহফিলে এক বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন “আমি ছারছীনার মরহুম পীর হযরত মাওলানা নেছার উদ্দীন আহমদ (রহ.) এর নিকট চিশতিয়া, নকশাবন্দীয়া, মুজাদ্দিদিয়া ও মুহাম্মাদ্দিয়া তরিকা মশ্ক করেছি। আমি যেহেতু ছাত্র জীবন হতে ওলামা, মাশায়েখ ও ইসলামী নেতৃৃবৃন্দকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আন্দোলন চালিয়ে আসছি। আমি স্বতন্ত্র কোন ছেলছেলা জারী করলে তা আমার উদ্দেশ্য সাধনের পথে বিঘœ সৃষ্টি হতে পারে। এ চিন্তা করে আমি কাউকে মুরীদ করতামনা। এখন দেখতেছি যে, কিছু লোক এমন রয়েছে, যারা কেবল আমার-ই নিকট মুরীদ হতে চায়। আমি মুরীদ না করলে অন্য কারও নিকট মুরীদ হবেনা। আর আমি যে তাহরীক (আন্দোলন) চালাচ্ছি তা সফল করতে এধরনের কিছু ফেদা (উৎসর্গীত) লোক অপরিহার্য। এমত অবস্থায় আমি আমার শায়খের নিকট হতে যা শিখেছি তা অন্যকে বাতিয়ে দেয়া আবশ্যক মনে করছি। তাই অদ্য থেকে আমি তরীকার বাইয়াত গ্রহনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি”। হুজুর কেবলা ইলমে তাসাউফ অর্জণ ও তাঁর শায়খের নেক তাওয়াজ্জুহ ও বিশেষ ছোহবাতে খুব দ্র”ত তরীকতের সর্ব্বোচ্চ মাকামে পৌঁছতে সক্ষম হয়ে ছিলেন। এর সুষ্পষ্ট নযির আমরা দেখতে পেয়েছি তাঁর চরিত্রে, প্রতিটি কাজ-কর্মে ও আচার-আচারণে। তথ্য সূত্র নেছারাবাদ কমপ্লেক্স ট্রাস্ট ঝালকাঠি। চলবে