বেঁচে থাকার সংগ্রামে আইএস বন্দিশালা থেকে মুক্ত ইয়াজিদি নারীরা


ক্যাম্পে বসে সেলাই করছেন লাইলাহ শেমো। ছবি : এএফপি
ইরাকের উত্তরাঞ্চলে বাস্তুচ্যুতদের ক্যাম্পের একটি ছোট তাঁবুর মেঝেতে বসে গোলাপি রঙের একটি ফুলেল জামা সেলাই করছেন এক নারী। তাঁর নাম লাইলাহ শেমো। ইরাকের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের একজন তিনি। আইএসের বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছেন এই খানকে ক্যাম্পে। শুধু লাইলাহই নন, এই ক্যাম্পে আশ্রয় পেয়েছে তাঁর মতো আরো অনেক ইয়াজিদি নারী।
আইএস বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেলেও ক্যাম্পে এসে তাদের নামতে হয়েছে বেঁচে থাকার সংগ্রামে। এই নারীদের অনেকেরই স্বামী ও পরিবারের উপার্জনক্ষম অন্য পুরুষরা এখনো নিখোঁজ। ফলে অর্থ উপার্জনে নেমে পড়তে হয়েছে তাদেরই। সেলাইয়ের কাজ, পার্লারের কাজসহ আরো নানা কাজে যুক্ত হয়ে নিজেদের ও পরিবারের খরচ জোগাচ্ছে তারা।
খানকে ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, লাইলাহ তাঁর তাঁবুতে একমনে কাজ করে চলেছেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে নিজের বাঁ হাতে স্বামী কেরোর নামে করা ট্যাটু দেখালেন। কেরো ২০১৪ সালে সিনজার রাজ্যে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের ওপর আইএসের হামলার পর থেকে নিখোঁজ। লাইলাহ সে সময় সাত মাসের গর্ভবতী ছিলেন। কেরোর সঙ্গে তাঁকে ও তাঁর চার সন্তানকেও বন্দি করে নিয়ে যায় আইএস। বন্দিশালায়ই পঞ্চম সন্তানের জন্ম দেন তিনি। একসময় তিন সন্তানসহ সেই দুঃসহ বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও স্বামী কেরো ও দুই সন্তান ফিরতে পারেনি তাঁর সঙ্গে। এরপর পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। এখনো আশা ছাড়েননি লাইলাহ। তাঁর বিশ্বাস, একদিন তাঁর স্বামী-সন্তান ফিরে আসবে।
স্বামী না ফিরে আসা পর্যন্ত সেলাই করে সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন তিনি। শিখ এনজিও খালসা এইডের দেওয়া সেলাইমেশিন আর কাপড় দিয়ে করছেন সেলাইয়ের ব্যবসা। ক্যাম্পের নবজাতকের পোশাক থেকে শুরু করে বিচিত্র নকশার বালিশের কভার—সবই তৈরি করেন তিনি। গর্বের সঙ্গে জানালেন, উপার্জিত অর্থ দিয়ে নিজের ছেলে-মেয়ে, বোন, এমনকি বোনের স্বামীর খরচও জোগাচ্ছেন। লাইলাহর মতো ক্যাম্পের আরো অনেক ইয়াজিদি নারী তাদের স্বামী ও সন্তানের অপেক্ষায় দিন গুনছে। চালিয়ে যাচ্ছে জীবনসংগ্রাম। এমনই আরেকজন হলেন ৩০ বছর বয়সী আসমা। ২০১৪ সালে আইএসের হামলার পর থেকেই এই ক্যাম্পে আছেন তিনি। জিন্দা ফাউন্ডেশন নামের একটি এনজিওর সহায়তায় এখানে ছোট একটি পার্লার চালিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন। আসমা বলেন, ‘আমার পরিবারে একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি দরকার ছিল। আমিই এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি। অথচ সিনজারে থাকা অবস্থায় কোনো নারীর চাকরি বা ব্যবসা করাকে অসম্মানজনক ভাবা হতো।’ আসমার এই পার্লারে নারীরা শুধু সৌন্দর্যচর্চার জন্যই আসে না, এটি তাদের একত্র হওয়ার একটি জায়গায় পরিণত হয়েছে। ২০১৪ সালে আইএসের আক্রমণের আগে ইরাকে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে পাঁচ লাখ। তাদের মধ্যে এক লাখের মতো বিদেশে চলে যেতে পেরেছে। সাড়ে তিন লাখেরও বেশি ইয়াজিদি বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশে রয়ে গেছে। গত পাঁচ বছরে আইএসের বন্দিশালা থেকে তিন হাজারের মতো ইয়াজিদি ফিরে আসতে পেরেছে, যাদের মাত্র ১০ শতাংশ পুরুষ।