সময় // কবি জিয়াউল হক

জীবনের পথে পেয়েছিলে সাথে,
পেয়েছিলে রতন- করনি যতন
হয়েছে বিলীন;
পাবে না পাবে না তারে
আর কোন দিন।
এসেছিল দ্বারে কভূ বারে বারে –
করনি আদর হয়েছে বিলীন;
পাবে না পাবে না তারে
আর কোন দিন।
রতন মানিক চিন নিকো ভাই
চিনেছো শুধুই টাকা;
আজ কেন ভাই মরণ কালে
ভাবছো নিজেকে বোকা?
প্রসাদ বাড়ি, বাগ- বাগিচা
করেছো যতন করে-
সময় গিয়েছে কালের ঘড়িতে
রাখতে পারনি ধরে।
আজ কেন ভাই সময় বলিয়া
কাঁদিয়া কাঁদিয়া মর!
ক্ষুদ্র সময় চলিয়া গিয়াছে
অসীম সময় ধর।
মহাকাল ধরি কাঁদিলেও আর
পাবে না তাকে ফিরে;
যেটুকু আছে, সেটুকু কাটাও
আল্লাহ্ আল্লাহ্ করে।
সময় কবিতার আলোচনাঃ সময় কবিতা বিশ্লেষণে দার্শনিক কবি জিয়াউল হক জীবনের সাথে সময়ের ছন্দোবদ্ধ অবভাসে সময়কে আমাদের সারবান ভাবনায় বিভোর করেছেন। কাব্যিক অবভাসের এ নদিত ভাবনার নতিজা প্রশ্নবিদ্ধ। কোথায় ছিলাম? কোথায় এলাম? কোথায় যেতে হবে? মরে যেতে হবে। এ মরার ধর্মে কিন্তু নাস্তিকও আছেন। ইওমে আজলে আল্লাহর হুকুমে আমাদের রুহ সৃষ্টি করলেন। আমরা আলমে আরওয়াহে অবস্থান করলাম। সেটাই প্রথম জিন্দেগী। নির্ধারিত সময়ে মায়ের রেহেমে এলাম। সে জিন্দেগীর পর এলাম আলমে নাচুত বা পার্থিব জগতে। এ জগতে আসার কারণ আল্লাহকে দে’য়া ওয়াদা অনুসারে সত্য কথা, সৎ পথে থেকে তার ইবাদৎ করে সময় হলে আমলে আখেরাতে কবরে থাকতে হবে। এটাই বয়যখী জিন্দেগী। এরপর কৃতকর্মের বিচারের জন্য হাশরী জিন্দেগী এবং ভাল বা মন্দ ফল ভোগের জন্য নশরী জিন্দেগীতে অনন্তকাল মানুষ বেঁচে থাকবে। এসব জিন্দেগীর কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই কবি জিয়াউল হকের সময় কবিতা। কবিত্ব শক্তি তো তাওয়াজ্জাহবিল গায়েব বা আধ্যাত্মিক প্রযুক্তি। সমাজের কাছে কবির দায়বদ্ধতা আছে। কবি যেন মুয়াজ্জিম। কবি যেন ঘুম ভাঙ্গানোর নকিব। যুগোপযোগী পথ প্রদর্শক। এক্ষেত্রে কবি জিয়াউল হকের এ সময় কবিতাটির গুরুত্ব উপলদ্ধি করার যে চেতনা ও অনুপ্রেরণা রয়েছে তা মানুষকে সিরাতুল মোস্তাকিমে নেয়ার আহবানে পরিপূর্ণ। নিয়ম ও সময়কে অবহেলা করে আমরা সময়ের কাজ সময় মত করিনি। তাই কবি দুঃখ ভরা হৃদয়ে আপছোস করে বলেন,
পাবে না পাবে না তারে আর কোন দিন।
অবহেলায় আমরা সময়ের গুরুত্ব না বুঝে দুনিয়ায় ও পিছিয়ে পড়েছি এবং আল্লাহকে দেয়া ওয়াদা অনুসারে তার কাছে প্রার্থণাও করিনি। এখন যতই চেষ্টা করি। পেছনের সময়কে আর ফিরিয়ে আনতে পারব না। কবি ভারাক্রান্তমনে তাই অচেনা মানুষকে বলে-
“রতন মানিক চিন নিকো ভাই
চিনেছো শুধুই টাকা;
আজ কেন ভাই মরণ কালে
ভাবছো নিজেকে বোকা।
সময়ের যথার্থ কাজ আমরা অনেকেই করিনা। কারণ রুটি রুজির আয়ের কাজ করলেই চলে না। মানুষ হিসেবে তার আরও অনেক কাজ রয়েছে। মা-বাবার সেবা,দুঃখি মানুষের পাশে দাড়ানো, দেশের স্বার্থে দায়িত্ব কর্তব্য পালন এবং আল্লাহ নির্ধারিত নামাজ রোজা পালন করা। এসব কাজের সময়কে কবি মানিক রতনের উপমায় উপমিত করেছেন। কবি বলেন, টাকায়ও যা মেলে না, তোমরা তা না চিনে শুধু টাকার চিন্তায় কাজে বিভোর হয়ে সময় নষ্ট করেছ। অন্তিম কালে পরোপারে যাবার সময় এখন বোকা হয়ে কাঁদো।
প্রসাদ বাড়ি বাগ বাগিচা-
করেছো -যতন করে
সময় গিয়েছে কালের ঘড়িতে
রাখতে পারনি ধরে।
অর্থ লুভি মানুষ স্বার্থ খুজে খুজে ন্যায় অন্যায় বাদবিচার ভুলে প্রথম হয় আত্মপ্রতিষ্ঠিত।এদের সম্পর্কে ইংরেজ কবি বলেন,
ঐড়ি সঁপয ষধহফ
উড়বং ধ সড়হ ৎবধঁরৎব
এ কবিতাটির ঘটনাটি আরও চাই -আরও-চাই- বলে দৌড়াতে দৌড়াতে লোকটি মারা গেল।
তাইতো ফার্সি কবি বলেন,
তুতাওয়াঙ্গার গাস্তে-ইয়াজ-মালেমা –
ইজামা-গাস্তেছুদে আস হালেমা।
আরও টাকা, আরও টাকা কর, ওতো এই আছে এই নাই। কিন্তু টাকার লোভে পড়ে পরকালের ভাবনা মানুষ মনে করে না। তাইতো অর্থবিত্তি, সম্মান, সুখ্যাতি, জীবনের নিরাপত্তা, এরপর সন্তানদের জন্য বাড়ি গাড়ি বাগ বাগিচা রেখে যেতে মানুষ আল্লাহকে স্মরণ করারও সময় পায় না। মরণ কথা তার স্মরণ হয়না। চোখ মুদে চলে গেলে ঘর বাড়ি স্ত্রী, সন্তান কোনো কাজে লাগেবেনা। প্রার্থনার সময় হয়না- সময় হয় আয় করতে। পরকালের আয় কিভাবে করবে এ ভাবনা তার মাথায় আসেনা।
আজ কেন ভাই সময় বলিয়া
কাদিয়া মর
ক্ষুদ্র সময় চলিয়া গিয়াছে
অসীম সময় ধর।
কবি স্বভাব সত্ত্বার সজ্ঞার সাহায্যে অনেক প্রাজ্ঞ। রুহানি ভাবেই সে সিরাতাল মোস্তাকিম ও মোদাল্লিনের মুখাবের। কাজেই পার্থিব জীবন শত বছর হলেও তা কবরের বরযখী জীবনের তুলনায় তুলনাতীত ক্ষুদ্রতম। আবার বরযখী জীবনের তুলনায় হাশরের জীবন অনেক অনেক বেশি সময়। নশরী জীবন কিন্তু অনন্ত কাল। সিদ্ধ পুরুষ কবি জিয়াউল হক ইওমে আজল থেকে নশরী জীবন পর্যন্ত চিন্তা করে সেই অসীম সময়ের কথা কবিতায় এনে বলেন-
মহাকাল ধরি কাঁদিলেও আর
পাবেনা তাকে ফিরে,
যে টুকু আছে, সেটুকু কাটাও
আল্লাহ আল্লাহ করে।
কবি জিয়াউল হকের সময় কবিতার আলোকে তাকে ধর্মীয় দার্শনিক বলা উচিৎ। কেননা, খোদা প্রাপ্তির সিরাতাল মোস্তাকিমের পথের ভাবুক কবিরাই স্বভাব কবি এবং স্বভাব কবি বলতেই সজ্ঞা, প্রজ্ঞা ও এলহাম প্রাপ্ত এলেমে মারেফতের লোক। এদের কথাই পবিত্র কুরআনের সুরায় আল্লাহ উল্লেখ করেছেন, যা প্রাক কথায় বিস্তারিত লিখেছি। আল্লাহর কাছে সব মানুষই সমান। এমনকি নাস্তিককেও তিনি না খাইয়ে মারেন না। মানুষ পৃথিবীতে আসার সময় আল্লাহকে ওয়াদা দিয়ে এসেছিলো যে, সৎ পথে থাকবে, সৎ চিন্তা করবে, সৎ ভাবে আয় করবে, কাকেও হিংসা করবে না এবং পার্থিব কাজের সাথে আল্লাহর প্রার্থনা আগে করবে। অতএব, সময় কবিতাটির জন্য কবি জিয়াউল হককে দার্শনিক কবি বলা যায়। সময় কবিতার সত্ত্বায় রয়েছে পবিত্র হাদিসের “মান আরাফ নাফসালু, ফাক্কাদ আরাফারাবাহু- যা পবিত্র বাইবেলের শহড়ি know they self এবং পবিত্রগীতার আত্মনং বিদ্ধি। আল্লাহ প্রার্থনার কাঙাল না। প্রার্থনা করলে আত্মসুদ্ধি আসে।
তখন সে সুরা মাউনের হক আদায় করে। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়, গরিবের হক আদায় করে এবং হিসেব করে যাকাত দেয়। মরার সময় এসব চিন্তা করলে লাভ হয়না। এসব চিন্তা করার সময় জীবন আরম্ভ থেকেই । কেননা, মানুষ আগুন, পানি, মাটি, হাওয়া এ চারটি প্রাকৃতিক উপাদান তৈরি করতে পারেনা। কাজেই এর মালিক সকলেই। এক্ষেত্রে মানুষ জন্মগত ভাবে স্বাধীন। কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে মানষ মানুষকে শোষণ করে থাকে। যতদিন পৃথিবীতে ব্যক্তি মালিকানা থাকবে ততোদিনই শোষণ থাকবে। মানুষ ব্যক্তিগত ভাবে স্বার্থ খুজে অপরের চিন্তা করবে না। তাইতো নবী করীম (সঃ) মদিনার খেজুর পাতার মসজিদে বসেই ঘোষণা করেছিলেন- “মানতারকা দহিমান আওজিয়া আনফা আলাইয়া”। অর্থ্যাৎ বায়তুল মান সমগ্র গরিবের দায়িত্ব নেবে। এরপর কোরআনুল করিম ও ঘোষণা করা হয়েছে যাকাত দেয়ার কথা। ধনীরা নিয়মিত যাকাত দিলে বারো বছরে ধনী গরিব সমান হয়ে যায়। তখন আর শোষণ থাকেনা। এবং মানুষ স্বার্থ খুজে খুজে সময়কেও নষ্ট করেনা। কবি জিয়াউল হক বিরচিত সময় কবিতাটি একটি যুগপোযগী স্বার্থক কবিতা।