স্বর্গীয় শ্রী মানিক লাল সাহা //কবি শিকদার রেজাউল করিম

শিকদার রেজাউল করিম কৃত বৃহতী গৌরনদী ইতিহাস ১ম খÐ ১৮৭ পৃষ্টা থেকে কবি পলাশ তালুকদার।
জমিদার পুত্র ছিলেন সংগীত জগতের জমিদার।

মানিক লাল সাহা একটি নক্ষত্রের নাম। আজও বহমান আছে গৌরনদী সংস্কৃতি অঙ্গনে তার গানের সুনাম। তাই তো এ গুনীজন তার মহৎ গুণ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন ‘কুহুতান সংগীত বিদ্যালয়’। ১৯৩৯ সনে গৌরনদী থানার অন্তর্গত আশোকাঠী গ্রামের সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে সংগীত শিল্পী মানিক লাল সাহার জন্ম। তার পিতা বাবু মোহনলাল সাহা। বাবু মোহনলাল সাহা সুনামের সাথে বহুদিন জমিদারী পরিচালনা করেন। মানিক লাল সাহা ছিলেন বাবা মায়ের অষ্টম সন্তান। বাবা মা আদর সোহাগ করে নাম রেখেছিলেন মানিক। সত্যিই মানিক মানে রতœ, তাইতো সংগীত জগতে অন্তঃত গৌরনদীতে তিনি মানিক হয়েই জন্মেছিলেন।

ছোট বেলা থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি গানের নেশায় পেয়েছিল। তবে লেখাপড়ায়ও ছিলেন খুবই ভাল। জমিদার বাড়ির মন্দিরেই ছিল পাঠশালা। ছোটরাই সেখানে পড়াশুনা করত। পাঠশালা শেষ করে তার পিতা মোহনলাল সাহার প্রতিষ্ঠিত পালরদী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি. পরীক্ষায় সুনামের সাথে পাশ করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি সংগীত চর্চাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আই.এ ও বি.এ পাশ করে চাখার ফজলুল হক কলেজ থেকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাশ করেন বাংলায়। জাত শিল্পীদের মন স্থায়ীভাবে কখনো এক জায়গায় থাকে না। তিনি স্বাধীনতার পরপর ফরিদপুর নগরকান্দা কলেজের বাংলা বিভাগে সুনামের সাথে অধ্যাপনা শুরু করেন। বেশ কয়েক বছর চাকরী করার পর চলে এলেন গৌরনদীতে। গৌরনদী আসার পরে বাবা-মা আনুষ্ঠানিকভাবে তার বিবাহ কার্য সম্পন্ন করেন। তার বিবাহিত জীবন ছিল খুবই সুখময়। বাবু মোহন লাল সাহা ছেলের জন্য নিজেই একটি শিল্পীমনা মেয়েকে পছন্দ করেন। তার স্ত্রী ছিল স্বাধীন বাংলা বেতারের সনামধন্য সংগীত শিল্পী। মানিক লাল সাহার স্ত্রীর নাম অরুণা সাহা। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই খুলনা বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। তাঁদের দুজনকে এক জায়গায ধরে রাখা গেলনা। তাই তো চাকরি ছেড়ে দিয়ে গৌরনদীতে এসে তাঁর স্ত্রীকে বলেন, ‘চলো আমরা গৌরনদীতে একটি সংগীত বিদ্যালয় খুলব’। স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে শুরু করে দিলেন গানের ক্লাশ। প্রথম অবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। বাবা মোহন বাবু যেমন ছাত্র-শিক্ষককে খাইয়ে পড়িয়ে পালরদী স্কুল গঠন করেছিলেন ঠিক তার ছেলে মানিকও তার মত ছাত্র-ছাত্রীদের ঘর থেকে টেনে বের করে সৃষ্টি করেছিলেন অনেক শিল্পী। মানিক লাল সাহা অরুনা সাহাকে বলতেন, জানো, কোন কিছু সৃষ্টি করার আনন্দটা অনেক। তার ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল একটা গানের স্কুল করার। আর সেই স্কুলে গান শিখবে কচিকাঁচা শিশুরা। তার স্বপ্ন পূরণ হলো। অনেক কষ্টে তৈরী হলো গানের স্কুল। ঈশ্বর তাকে বেশী দিন সুস্থ রাখলেন না। তাঁর ছিল হৃদরোগের সমস্যা। তখনকার ডাক্টাররা হৃদ রোগ ধরতে পারতেন না। মানিক লাল সাহা গানের স্কুলকে মনে করতেন মন্দির। তাইতো মন্দির ছেড়ে বাড়ীতে আসতেন না। একদিন গান গাইতে গাইতে অসুস্থ্য হয়ে পড়ে গিয়েছিল গানের স্কুলে। বেশ অসুখ তার। গানের স্কুল থেকে তাকে বাড়ী নিয়ে এলো। যত চিকিৎসাই করা হোক না কেন অসুখ তাকে ছাড়ছে না। তিনি আর স্কুলে যেতে পারলেন না। বাড়ীতে বসে ছাত্র-ছাত্রীদের গানের ক্লাশ নিতেন। অসুখ দিন দিন আরো বেশী বেরে গেল। হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। ১৫ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতে মাত্র ৫২ বৎসর বয়সে স্বর্গীয় হয়ে গেলেন। কে বলে মানিক লাল সাহা স্বর্গীয় হয়ে চলে গেছেন। আমি দেখি প্রতিদিনি মানিক লাল সাহা তার বর্তমান গৌরনদী শিশু একাডেমিতে বসে সঙ্গীত পরিবেশন করছেন।

তার সৃষ্টি শিল্পী গোবিন্দ লাল সাহা, ব্যান্ড শিল্পী জুয়েল, রুবি আক্তার, সন্ধ্যা বিশ্বাস, বাবুল সোম, কাজী সেকেন্দার, আমিন মোল্লা, ডলি বণিক আজ তার গান গাইছে। হাজার হাজার শিল্পী সৃষ্টি হয়েছে শিশু একাডেমী থেকে। কত শিল্পী পেয়েছে জেলা এবং বিভাগীয় পুরস্কার। বাংলার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানিক লাল সাহার ছাত্র-ছাত্রী। আমাদের গৌরনদী শিল্পীদের সংগীত গুরু তার স্ত্রী, ছেলে শ্রী রাজা রাম সাহা, মেয়ে আইভি সাহা কে রেখে ১৯৯১ সনে ২৪শে ফেব্রæয়ারি মারা যান। মানিক লাল সাহার দু’চোখের স্বপ্ন, তার বাসনা-কামনা ছিল গৌরনদী শিশু একাডেমি যুগ যুগ বহমান থাকে যেন। তাইতো গৌরনদী শিশু একাডেমি আজও চলমান আছে তার নির্দিষ্ট গতিতে। তার সেই একাডেমী থেকে বের হচ্ছে নৃত্যশিল্পী, তবলা বাদক, বাঁশী বাদক, নানা রকম শিল্পী। গৌরনদী শিশু একাডেমি আজ একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ একাডেমিতে পরিণত হয়েছে।
গৌরনদী শিশু একাডেমি যুগ যুগ বেচে থাক এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের। কবি, নাট্যকার সিকদার রেজাউল করিমের ভাষায়,
জাতিরূপ দেহে প্রাণ
সে জাতির সংস্কৃতি
সমাজ গড়ার মেকার হয়ে
সংস্কৃতিমান করে স্তুতি।
ধুপছায়ার মত নিঃশেষে শিল্পী
শিল্পীত সমাজ
চর্চা পীঠ গড়ে শিল্পী মানিক লাল
করে গেছে অমরত্মের কাজ।
যুগ যুগ বেচে রবে
শিশু একাডেমী
গৌরনদী শিল্পকর্মে
না দিয়াছে খেমি।