আমি জনতার // কবি জিয়াউল হক

আমি যেখানেই যাই, সেখানেই যেন-
কায়াটি আমার ছায়া হয়ে থাকে
মানুষের ঘরে ঘরে।
জনতার সুখে ধন্য করি
ক্ষুদ্র এ জীবনটারে।
চাইনা যে আমি সুখ সম্মান
চাইনা প্রাসাদ বাড়ি,
মানুষের মাঝে থাকিয়া যেন
মানুষেরই দাবি করি।
সকলেরে রাখি কভু যেন আমি
করিনা স্বর্গে বাস,
অবিচার যদি লই মানিয়া
হই যেন আমি লাশ।
আজীবন যেন জনতার দাবি
কাঁধে তুলে নিতে পারি;
লোভ লালসায় বিভোর হইয়া
যাইনা সকলে ছাড়ি।
হে মহাপ্রভূ তোমার কাছেতে
চাইনাকো আমি সুখ,
আপন করিয়া লই যেন মেনে
বঞ্চিতদের দুঃখ্।
হে রাজাধিরাজ
তুমি তো শুনেছি সব কিছুই পারো-
বঞ্চিতদের এতো দুঃখ তুমি কেমনে হজম কর?
শুনেছি সকল বানিয়েছ তুমি তোমারই হাতের দ্বারা;
কেন বানিয়েছ দুইভাগে হায় ধনী ও সর্বহারা!
হে বিধাতা,
আমি জনতার, আমি বঞ্চিতের, আমিতো ধনীর নই-
বুভূক্ষদের অন্ন জোগায়ে আমি যেন ধন্য হই।
আমি যেন আসি রাত্রি নিশীথে জনতার দ্বারে দ্বারে,
আমি যেন থাকি স্বর্গ ছেড়ে রুগ্নদের শিয়রে।
আমি যেন কভূ হইনা কঠোর দুঃখি জনের তরে,
আপন ভাবিয়া লই যেন তুলে জনতার দাবি ঘাড়ে।
আমি জনতার, আমি জনতার, এইতো শপথ করি-
নিজেকে ছাড়িয়া সকলেরে যেন উর্দ্ধে তুলিয়া ধরি।
আমি জনতার কবিতার আলোচনাঃ আমি জনতার কবিতায় কবি জিয়াউল হকের কাব্যিক সৌন্দর্যর মূলে রয়েছে Occasional, গুণ, Non performing arts folk tales moithes এবং Anecdotes সংঘটিত ক্ষুদ্র কাহিনী যা পাঠকের কানে প্রাণে ভালো লাগে এবং তার ভেতর ঊধমবৎহবংং তেরি হয়। মানব সেবার জন্য বিশেষ করে গরিব মানুষের খোজ খবর নিতে হযরত ওমর রাঃ গভীর রাতে একাকী ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন এবং তিনি নিজে কখোনো দু বেলা পেট ভরে খাননি এ ভাবনায় যে; হয়ত বা কেউ অনাহারে রয়েছে। তাইতো কথিত আছে –
“আটার বস্তা মাথায় করে
ওমরে যায় ঘরে ঘরে”
এমন মিথ আমরা বাগদাদের মহান খলিফা হারুন-অর-রশিদ এবং দানের জগতের শ্রেষ্ঠ মনীষী হাতেম বীন তাঈ এর জীবনিতেও পাই; যা আজ মিত আকারে মানুষের মনে লেগে আছে। অনুরুপ ভাবনায় কবি জিয়াউল হকের মনীষার ত্যাগের মহিমায়ই আমি জনতার কবিতাটি পরিষ্ফুটিত হয়েছে।
কবির কাজও মনুষ্যত্ব সমাজে বহমান পরিস্থিতির দায় দায়িত্ব বহন করা। ধনী গরিব শোষক ও শোষিত সামাজিক প্রেক্ষাপটের ওপর তার পরীষ্টি। নিঃস্ব মানুষের পক্ষে কথা বলা ও কাজ করা কবির কর্তব্য । গভীর অনুধ্যানে ও দেখা যায় কবিতার হাত, কান, মুখ, নাক, গলা শ্বাস-প্রশ্বাস সবই রয়েছে। বাংলা কবিতার সব গুনই এ কবিতাটিতে বহমান। কবি জিয়াউল হক বুদ্ধি বিবেক ও বিচার জ্ঞান খাটিয়ে, অস্টúাশ মুক্ত মনুষত্বে, তত্ত¡জ্ঞান সুত্রমতে বুঝতে পেরেছেন যে, ছায়ার সাথে কায়ার যেমন সম্পর্ক, অনুরূপ দেহের সাথে মনেরও সম্পর্ক জড়িত। এ গভীর ভাবনায় মানুষই সজ্ঞা, প্রজ্ঞা প্রাপ্ত হয়। ফলে পার্থিব যশ খ্যাতি অর্জনের মোহে পুরস্কারের আশায় মানুষের সাথে দ্ব›েদ্ব জড়ায় না। কারণ এরা জানেন যে, “জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।”
অনুরূপ লালন ফকির বলেছেন-“সু² প্রেম যে করেছে রতি মথির ধার ধারেনা।
সু² প্রেম এক আত্মার সাথে আর এক আত্মারসংযোগ।
তাইতো ইমাম আল গাজ্জালী বলেছেন, সব চেয়ে বড় নফল এবাদৎ হল মানুষকে আর্থিক উপকার করা। এ পথের সর্বক্ষণই আল্লাহ প্রদত্ত রুহানী জ্ঞান লাভ করতে পারেন। এ ধরণের জ্ঞানীই আধ্যাত্মিক প্রযুক্তি বা তাওয়াজ্জাহবিল গায়েব প্রাপ্ত সাধক। মানুষের পাপ পুণ্য যা কিছু এ জগতে করে মহাজগতে অবিকল তা ভিডিও হতে থাকে, এটাই বিজ্ঞানের আইডিনটিক্যাল টুইন।
বুদ্ধি বিবেক ও বিচার জ্ঞান খাটালে এ অতীন্দ্রিয় সত্ত¡া মানুষের চোখে ধরা পড়ে। অতীন্দ্রিয় সত্ত¡া অর্জিত কবিগুরুর সামনে এসে তাই তান্ত্রিক জার্মান দম্পত্তির যাদু অচল হয়েছিল। অতীন্দ্রিয় সত্ত¡া প্রমাণ দেখতে গিয়েই বিদ্রোহী কবিকে থেমে যেতে হয়েছে। অতীন্দ্রিয় সত্ত¡ার নেসবতে সাধারণ মানুষও চেষ্টা করলে পৌছতে পারে যদি সে সেরাতাল মোস্তাকিমে চলে। যদি অতীন্দ্রিয় সত্ত¡ার নেসবত অর্জনে সাধারণ মানুষও চেষ্টা করলে পৌছতে পারার শর্ত মানে। যদি সত্যের সাধক পরোপচিকীর্ষায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়। অতীন্দ্রিয় সত্ত¡ার বলেই তাপসী রাবেয়া বলেছিলেন, “আমি বেহেশতের আশায় নামাজ পড়ে থাকলে তুমি নামাজ ধরে আমার গায়ে নিক্ষেপ কর। অতীন্দিয় সত্ত¡া জনতার মুখে মুখে বিরাজিত। কবি জিয়াউল হক বিরচিত আমি জনতার কবিতাটি আসমানি নাম। ফ্রান্সের কবি পলভ্যালরীর ভাষার উপমায় বলা যায় কবিতায় প্রথম লাইন আাসে স্বর্গ থেকে। তাইতো সাধক বলেছেন- কবিরা আল্লাহর ছাত্র। তাদের বিদ্রæপ কর না।
বিত্তের রাশি আর চিত্তের ধনী এক ভাবনার হতে পারেনা।
তাইতো শতাব্দীর শতায়ু গমন কবিতায় কবি ফজল মোবারক লিখেছেন, পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাথে সন্ধি স্থাপনের কথা। প্রাণি মাত্রেই আহার নিদ্রা ভয় ও মৈথুনেচ্চায় প্রলুব্ধ হয়। কিন্তু বিবেক বিচারে কামের মোহ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্যই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব।
যাহোক, আমাদের এখন আলোচ্য কবি জিয়াউল হক বিরচিত আমি জনতার কবিতাটি কবি তার দৈহিক অঙ্গসৌষ্ঠব এবং মূল্যবোধের আলোকে কবির মনুষত্ব উৎকর্ষ সাধিত। স্বর্গীয় প্রেমময় মনুষত্ব প্রতি ছত্রে ছত্রে বিকশিত হয়েছে। মানব সেবার আশায় কিশোর কবি ঘরে ঘরে গজাতে তার হৃদয় কন্দরে ব্যক্ত হয়েছে।
“কায়াটি আমার ছায়া হয়ে থাকে
মানুষের ঘরে ঘরে।
মানুষের জন্য মানুষ, মানুষের উপকারে নিজেকে শর্তহীন ভাবে নিয়োজিত রাখা সিদ্ধ পুরুষদের কাজ।
কবি অঙ্গীকার করেছেন-
“জনতার সুখে ধন্য করি
ক্ষুদ্র এ জীবন টারে।
জনতার সেবায় কবি নিজেকে ধন্য করতে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, ত্যাগেই সুখ, ভোগে নয়। কবি তাই বলেন-
“চাইনা আমি সুখ সম্মান
চাইনা প্রসাদ বাড়ি।”
কবি বিভব, বিত্ত সুনাম, সম্মান, প্রভাব প্রতিপত্তি জীবনের নিরাপত্তা ও সন্তানদের জন্য সম্পত্তি রেখে যাওয়া এসব চিন্তা ভাবনা থেকে নিজেকে দূরে রেখে শুধু নিস্ব, নিরহ, ভূখা, নাঙা, দুঃখিজনের দুঃখ ঘুচিয়ে সকলের সাথে সমভাবে মিলে মিশে থেকে তাদের দুঃখ দারিদ্র দূর করতে পারেন এমন বাসনা মনে পোষণ করেছেন।
কবি বিপন্ন মানুষের পাশে দাড়িয়ে , তাদের সাধ্যানুগ সহায়তা করে সকলের সাথে মিলে মিশে বসবাসের কথা ব্যক্ত করেছেন।সকলকে দুঃখ কষ্টে রেখে কবি একাকী স্বর্গ বাসেও নারাজ। কবির চেতনশীল হৃদয় কন্দরে অত্যাচারিত মানুষের পক্ষে, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করলে তিনি যেন মারা যান এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
কবি ব্যক্ত করেছেন-
“আজীবন যেন জনতার দাবি
কাঁধে তুলে নিতে পারি,
লোভ ললসায় বিভোর হইয়া
যাইনা সকলে ছাড়ি।”
কবি ব্যক্ত করেছেন যে, সহায় সম্বলহীন , রিক্ত, নিঃস্ব, গরিব, দুঃখি, রোগাক্রান্ত বিপদগ্রস্থ মানুষের দাবিকে পূরণ করার দাযিত্ব থেকে তিনি যেন সরে না পড়েন। তিনি যেন নিজের সুখ শান্তি, আর্থিক প্রবৃদ্ধি এসব চিন্তা না করে, অভাবি মানুষের অভাব মোচন করতে পারেন। জগৎ নিয়ন্ত্রা আল্লাহর কাছে তাই কবির নিতান্তই ফরিয়াদ যে, তিনি সুখে বিভোর হতে ইচ্ছুক না। তার চেয়ে বরং সকলের জীবন যন্ত্রণার দুঃখ তার হোক এবং সকলে সুখি হোক।
বেশির ভাগ মানুষ অধিকার থেকে বঞ্চিত। এক শ্রেণির মানুষ খেতে পায়না। আরেক শ্রেণির মানুষের হাতে বিভব বিত্তের পাহাড় জমা আছে। তাই তিনি বিশ্ব নিয়ন্ত্রার কাছে প্রশ্ন করেছেন, কেন সর্বহারা শ্রেণি খেতে পড়তে পারবেনা। তারাকি তোমার সৃজিত নয়? তাই কবি সর্বহারাদের হয়ে তাদের সেবা করে তার সর্বস্ব ত্যাগ করতে ইচ্ছে পোষণ করেছেন।
কবি আল্লাহর কাছে আরও দাবি উথাপন করেছেন যে,
“আমি যেন আসি রাত্রি নিশিথে জনতার দ্বারে দ্বারে ,
আমি যেন থাকি স্বর্গ ছেড়ে রুগ্নদের সিয়রে”
কবির এ দাবি তো মোজামিয়াতের কথা। এ আরাধনা তো গঞ্জে মারে ফতেরই নির্দেষ। বিপন্ন মানুষের সেবায়ই প্রকৃত ধর্ম। সুরা মাউনে বর্ণিত হক আদায় করতে পেরেছেন আল্লাহর কাছে আত্ম সমার্পণ কারী এমন কতজন আছেন?
রোজ হাশরে বিচার কালে আল্লাহর জিজ্ঞেস থাকবে, রোগিদের সেবার কথা, অভাবি মানুষকে খাদ্য দানের কথা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ন্যায়ের পক্ষে নেতৃত্ব না দেয়ার শাস্তি। তাই খোদার ভয়ে কবি জনতার জন্য সর্বস্ব দান এবং তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন- আমি জনতার, আমি জরতার এইতো শপথ করি। নিজেকে ছাড়িয়া সকলেরে যেন ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরি।
কবি জিয়াউল হক বিরচিত আমি জনতার কবিতাটি, মোজামিয়াতের পথের পাথেয় এবং ভক্তি প্রেমে শান্ত রসের বাস্তব প্রমাণ।
এ কবিতাটির ম্যাসেজ হল – কবি হিসেবে দায় বদ্ধতা পালনে সর্বহারা শ্রেণির পাশে দাড়িয়ে, তাদের অধিকার আদায়ে রসুল (সঃ) বর্ণিত হাদিসটির অনুসরনেই কবি বলেছেন মদীনার খেজুর পাতার মসজিদে বসেই নবী গরিবের স্বার্থে ঘোষণা দিয়েছিলেন “মানতারকা দহিমান আওজিয়া আনফা আলাইয়া”। বায়তুলমাল সমগ্র গরিবের দায় বহন করবে। এ অনুকরণেই মাওলানা ভাষাণী বলেছিলেন, “কেউ খাবে তো কেউ খাবেনা তা বেনা তা হবেনা।” এ ক্ষেত্রে দেলি কবিসত্ত¡া সুফি হয়েছেন। সুফি হতে সুফি সাজতে হয়না। কাজ কর্ম সুফির আদলে এ কবিতার হকিকত বা হক কথার জন্য কবি জিয়াউল হকের কবিতাটি একটি সার্থক বাংলা কবিতা হয়েছে। বাংলা সংস্কৃতি, মিথ, রস, সমান বণ্টন সব গুণই কবিতায় বহমান।
কবি জিয়াউল হক ন্যাচারাল বা স্বভাব কবি। তিনি বাঙালি সাংস্ককৃতির কবি কিন্তু কুম্ভিলক বা প্লেজিয়ারিষ্ট হয়ে বাংলা কালচারের কবি নন।
কবিতা ধর্ম পালনে তিনি The truth of poetry পালনে পরিপূর্ণ সফল হয়েছেন।
আমি জনতার কবিতার শান্ত রসের মহত্ব ওদার্য প্রশংসার দাবিদার।
ইংরেজ সমালোচক Hamiltor কবিতার রসবোধ সম্পর্কে বলেন- Poetry, as such , is as to be judge simply by the quality of imaginative experience it gaves , and not by the test of moral goodness or of true in reference to something outside itself.
রস তত্ত¡ বিচারে ইহা একটি গুণ ও অভিজ্ঞতালব্ধ কল্পনা শক্তি যা নৈতিকভাবে সত্যের উপমা।